Friday 7 January 2011

নেপথ্যে বিদেশি এনজিও’র ভূমিকাও কাজ করেছে - বিজিএমইএ সভাপতি : পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ : বিদেশি ক্রেতারা আতঙ্কিত

সৈয়দ মিজানুর রহমান

পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। ২০০৯ সালে এ খাতে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ছিল ১৯১টি, গেল বছর তা বেড়ে হয়েছে ৮৩৪টি। গেল দুই বছরে এ খাতে শ্রমিক অসন্তোষের সহস্রাধিক ঘটনা স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, কারণে-অকারণে যে হারে পোশাক কারখানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হচ্ছে, তা দেখে মনে হয় এখন এ খাত পুরোপুরি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) গবেষণা সেল সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগের মধ্যে ২০১০ সালের জুনেই সবচেয়ে বেশি ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে পোশাক খাতে। এ সময়ে ৬০৪টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা রেকর্ড করেছে বিজিএমইএ। বিজিএমইএ’র গবেষণা সেল শ্রমিক অসন্তোষের কারণ ক্ষতিয়ে দেখতে গিয়ে প্রমাণ পেয়েছে—এসব ঘটনার বেশিরভাগই গুজব ছড়িয়ে ঘটানো হয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছেন কিছু শ্রমিক নেতা। তাদের উস্কানিতেই ছোটখাটো বিষয়গুলোও পোশাক শিল্পের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঝুট ব্যবসার আধিপত্য নিয়েও কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৬ সালে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার আগেও গোটা পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে সে বছর পোশাক শিল্পের ২৫৮টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল।
গত এক যুগে এতসংখ্যক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণ কী—জানতে চাইলে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী আমার দেশকে বলেন, ‘গেল একটি বছর এ খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এ সময় যেমন স্থানীয় সমস্যা ছিল, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও মন্দার কারণে রফতানি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবে এগুলোর সঙ্গে শ্রমিক অসন্তোষের কোনো সম্পর্ক নেই। শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনাগুলোর ৯০ ভাগই শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে ঘটানো হয়েছে। কিন্তু ইন্ধনদাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।’ বিজিএমইএ সভাপতি জানান, ২০১০ সালে মজুরি বেড়েছে ৮০ শতাংশ। তবে মজুরির দাবি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে মাত্র ৫৭টি কারখানায়। বাকি ৭৩১টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে ছিল কিছু শ্রমিক নেতানেত্রী। বিদেশি এনজিওদের ভূমিকাও কাজ করেছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে বিজিএমইএ সভাপতি আশা করেন, শিল্প পুলিশের কার্যক্রম চালু হওয়ায় সামনে এ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০২৫টি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। প্রায় প্রতিটি ঘটনার পর পরই সরকারের পুলিশ প্রশাসন তদন্ত করেছে। তদন্ত রিপোর্টও জমা পড়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে দেশের ২৫৮টি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। এ শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ১৩৫টি কারখানায় মজুরির জন্য এবং বাকি কারখানাগুলোয় অন্যান্য দাবিতে শ্রমিকরা কারখানায় অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট করেছে।
২০০৭ সালে ২৬৬টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। এর মধ্যে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ১৪২টি কারখানায় ও অন্যান্য দাবিতে ১২৪টি কারখানায় অসন্তোষ হয়েছে।
২০০৮ সালে ২২৫টি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়। মজুরি সংক্রান্ত কারণে অসন্তোষ হয়েছে ৭৮টি কারখানায় এবং অন্যান্য দাবিতে ১৪৭টি কারখানায়।
২০০৯ সালে ১৯১টি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয় বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১২টি, ফেবু্রয়ারিতে ১০টি, মার্চে ১৩টি, এপ্রিলে ২৩টি, মে মাসে ১৮টি, জুনে ১৮টি, জুলাইয়ে ২৫টি, আগস্টে ৩১টি, সেপ্টেম্বরে ১৮টি, অক্টোবরে ১২টি, নভেম্বরে ৮টি ও ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ৩টি শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে জানায় বিজিএমইএ। এসব ঘটনার মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত কারণে ৮৮টি কারখানায় এবং অন্যান্য কারণে ১০৩টি কারখানায় হামলা ও ভাংচুর হয়েছে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে পোশাক খাতে শ্রম অসন্তোষ ঘটেছে ১২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৪টি, মার্চে ২৫টি, এপ্রিলে ৩০টি, মে মাসে ১৫টি, জুনে ৬০৪টি, জুলাইয়ে ১৬টি, আগস্টে ১২টি, সেপ্টেম্বরে ১১টি, অক্টোবরে ১২টি, নভেম্বরে ২৭টি ও ডিসেম্বর মাসে ৫৬টি শ্রম অসন্তোষের ঘটনা রেকর্ড করেছে বিজিএমইএ।
কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাক খাতের সাধারণ শ্রমিকরা কারখানায় ভাংচুর ও লুটপাটে কমই জড়িত থাকে। এ ক্ষেত্রে কিছু শ্রমিক নেতার ইন্ধন বেশি দায়ী বলে মনে করেন তিনি। মোহাম্মদ হাতেম জানান, বিশ্ব মন্দার পর আমাদের অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে সুতার ভয়াবহ সঙ্কট, বন্দর জটিলতা, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে এ সম্ভাবনা খুব একটা কাজে লাগানো যাবে না।

No comments:

Post a Comment