Saturday 22 January 2011

আ’লীগ সরকারের দু’বছর : বোরকাবিরোধী তত্পরতায় ক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষ

রকিবুল হক

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই বছরে ইসলামবিরোধী বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের অন্যতম ছিল বোরকাবিরোধী তত্পরতা। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিসে মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে আদালতের রায় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারির ঘটনায় দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোরকাধারীদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের বিষয়টিও ছিল ব্যাপক সমালোচিত। সরকারের এসব অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করে। বিশিষ্ট আলেম-ওলামারা সরকার ও আদালতের এসব আদেশকে সরাসরি কোরআনবিরোধী আখ্যায়িত করে কোনো মুসলমান এটা মানবে না বলে ঘোষণা দেন। মহিলা মাদ্রাসাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব নিয়মানুযায়ী এখনও বোরকা পরা বাধ্যতামূলক রয়েছে বলে তারা জানান। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এ দেশে বোরকাবিরোধী আইনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত বছরের ২২ আগস্ট বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশনের এক আদেশে বলা হয়, ‘দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিসে মহিলা ও মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না’। একই সঙ্গে মেয়েদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত না রাখতেও নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিসে মহিলা ও মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্টের এ বেঞ্চ। সরকারের শিক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, সংস্কৃতি সচিব, সমাজকল্যাণ সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব এবং নাটোরের রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এছাড়া কলেজের অধ্যক্ষকে আদালতে হাজির এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়।
একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বোরকা না পরলে আসতে মানা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে তা আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক এবং অ্যাডভোকেট কেএম হাফিজুল আলম। তারা বলেন, সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের আওতায় পোশাক নির্বাচন ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয় হিসেবে সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকার। কাউকে এ নিয়ে বাধ্য মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু ছেলেরা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে এটা বেআইনি। মেয়েদেরও খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু ছেলেদের এসবের সুযোগ দিয়ে মেয়েদের বঞ্চিত করা বৈষম্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ বোরকা বাধ্যতামূলক করা যাবে না মর্মে আদেশ দেন। অবশ্য পত্রিকার ওই রিপোর্টে প্রকৃত ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ছাপানো হয়েছিল বলে কলেজ সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। এদিকে এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই রানী ভবানী কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রহিমা বেগম আমার দেশকে বলেন, গত বছর ২৩ আগস্ট মোজাম্মেল হককে অধ্যক্ষের পদ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে ওএসডি করা হয়। পরবর্তী সময়ে অধিদফতরের পক্ষ থেকে তদন্ত এবং তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।
হাইকোর্টের বোরকাবিরোধী এ রায়ের তিনদিনের মাথায় ২৫ আগস্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য না করা প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত ছাত্রীদের ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া হচ্ছে মর্মে সম্প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে— যা সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধা বিকাশের জন্য ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এমতাবস্থায় সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ নির্দেশনা দেয়া হলো। পরিপত্রে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না; ছাত্রীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া যাবে না; বোরকা না পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে নির্যাতন, হয়রানি বা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না; বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা এবং ছাত্রীদের খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান/ব্যবস্থাপনা কমিটি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বর্ণিত বিষয়গুলো প্রতিপালনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন; এবং বর্ণিত বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দফতর/অধিদফতর/শিক্ষা বোর্ড তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর আগে ২ মার্চ বোরকা না পরার কারণে কাউকে অযথা হয়রানি না করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগ। একটি জাতীয় দৈনিকে রংপুরে বোরকা না পরা নারীদের আটকের ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জাতীয় দৈনিকটিতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রংপুরের চিড়িয়াখানা ও সুরভী উদ্যানে বোরকা ছাড়া চলাফেরা করায় ১৯ যুবক-যুবতীকে আটক করে ডিবি পুলিশ। প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়, ডিবি পুলিশের দাবি হচ্ছে— ইসলামপরিপন্থী ও ধর্মীয় আইনবিরোধী কাজ করা এবং পর্দানশীন অবস্থায় চলাচল না করার কারণে তাদের আটক করা হয়। প্রকাশিত এ সংবাদটিকে একজন আইনজীবী আদালতের দৃষ্টিতে আনলে বোরকা না পরার কারণে কাউকে হয়রানি না করতে নির্দেশ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশ ইন্সপেক্টরকে তলব করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় বলেও জানা গেছে।
এদিকে বোরকা বিষয়ে আদালতের নির্দেশ এবং সরকারের পরিপত্রের পাশাপাশি বোরকাধারী ছাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের বিষয়টিও ছিল ব্যাপক সমালোচিত। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ইডেন এবং বদরুন্নেছা কলেজে বোরকাধারী ছাত্রীদের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ইডেন কলেজে বোরকা পরা ছাত্রীদের ধরে বোরকা খুলে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলেও তল্লাশির নামে পর্দানশীন ও নামাজি ছাত্রীদের হয়রানির ঘটনা ঘটে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের রুম থেকে ইসলামী বই-পুস্তককে জিহাদি বই বলে তা জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রশাসনের সহায়তায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সারাদেশে বোরকাধারী ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাজামা-পাঞ্জাবি ও বোরকা পরে আসতে নিষেধ করেন এক শিক্ষক। এছাড়া মহাজোট সরকারের সময় পিরোজপুরে বোরকা পরা শিক্ষকসহ তিন শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটক ও নির্যাতন করলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এসব কর্মকাণ্ডে বর্তমান সরকারকে ইসলামবিরোধী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন সংশ্লিষ্টরা।
বোরকার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারিসহ বিভিন্ন তত্পরতাকে সরকারের ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, পর্দা ইসলামের ফরজ বিধান। কাজেই এ ফরজ বিধানের বিরুদ্ধে কেউ রায় দিলে তা কেউ মানতে পারে না। এটা সরাসরি কোরআন-হাদিসের বিপরীত রায়। এ দেশের কোনো মুসলমান এ রায় মানবে না। এসব আইন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, এ সরকার ভাবছে গায়ের জোরে এসব আইন কার্যকর করবে; কিন্তু তা পারবে না। আইয়ুব খান কোরআনে হাত দিয়ে যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী সরকারও সেভাবে ধ্বংস হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম বোরকাবিরোধী হাইকোর্টের রায়কে পর্দা উচ্ছেদ করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করে বলেন, এ সরকারের টার্গেট হলো— বিভিন্ন দেশে যেভাবে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এ দেশেও সেই আইন করা। সরকারের পরিপত্র ও আদালতের রায় তারই ধারাবাহিকতা। অথচ পর্দা করা ফরজ বিধান। তাই আদালতের রায় ও সরকারের পরিপত্র এ ফরজ বিধানের খেলাপ। আদালত ‘অমুসলিমদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা যাবে না’— এ রায় দিতে পারত মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে তো ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক আছে। তাহলে বোরকাকেও ইউনিফর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করতে আপত্তি কোথায়? এ রায় শুধু ইসলামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর জন্য দেয়া হয়েছে। এটা মুসলমানরা কোনোদিন মেনে নিতে পারে না, মেনে নেবে না। এটা মানলে কেউ মুসলমান থাকবে না।

No comments:

Post a Comment