নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বছর ছিল ২০১০ সাল। হত্যা, খুন, শ্লীলতাহানি, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাসের পাশাপাশি নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে ইভটিজিং। এই বছরের শুরু থেকে ইভটিজিং দেশে মহামারি আকার ধারণ করে। বছরজুড়ে বখাটেদের হাতে প্রাণ হারান কোথাও মা, কোথাও বাবা, কোথাও শিক্ষক। এমনকি বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে ভাই, পুত্রবধূকে রক্ষা করতে গিয়ে শ্বশুরও খুন হয়েছেন ইভটিজারদের হাতে।
দেশজুড়ে নারী নির্যাতনের এসব চিত্রের অনেক খবরই জানা যায়নি। কিছু খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু ঘটনায় দেশের থানাগুলোতে মামলা হয়েছে। কিছু মামলা হয়েছে দেশের আদালতে অর্থাত্ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। এ বছর নারী নির্যাতন ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা সরকারও স্বীকার করেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন—এই ছয় মাসে সারাদেশে মোট ১ হাজার ৫৮৬ নারী ধর্ষিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানেও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির চিত্র ওঠে এসেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের থানাগুলোতে নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে ৪ হাজার ১০টি। শিশু নির্যাতন মামলা হয়েছে ৪৫০টি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করেছে ৪১৪টি, যৌতুক সহিংসতার ৩৫৪টি এবং এসিড নিক্ষেপের ১২৩টি ঘটনা রেকর্ড করে। ডিসেম্বর মাসে আমার দেশ-এ ৪৫টি যৌতুক সহিংসতা, ২৫টি ধর্ষণ এবং ৬টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসবের বাইরেও নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা রয়ে গেছে। এসব হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় চলতি বছর ছিল নারীর প্রতি সহিংসতার বছর।
ইভটিজিং ও বখাটেদের দৌরাত্ম্য রোধে ২ নভেম্বর সারাদেশে হাই অ্যালার্ট জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধের শিকার কিশোরী, তরুণী ও নারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও সরকারকে নির্দেশ দেন। এরপর দেশে কিছু মোবাইল কোর্ট, বিছিন্নভাবে কিছু জেল জরিমানা করা হয়েছে, কিন্তু বখাটেদের উপদ্রব রোধ হয়নি।
অধিকারের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান বলেন, নারীর প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতি, নারীর অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্বল প্রশাসন ইত্যাদি কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। ভিকটিম নারী বিচার না পাওয়ায় অপরাধীরা উত্সাহিত হচ্ছে ও গাণিতিক হারে সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে।
ইভজিটিং ও বখাটেপনা : চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ইভটিজিং। বখাটেদের উপদ্রবে বহু কিশোরী ও স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে নিজেদের সম্মান বাঁচিয়েছে। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি বখাটের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ঢাকায় নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাসপিয়া আকন পিংকি আত্মহত্যা করে। গত ৩ এপ্রিল বখাটের হাতে উত্ত্যক্ত হয়ে ঢাকার খিলগাঁও থানার নন্দিপাড়া এলাকায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরা (১৪) আত্মহত্যা করে। গত ৫ এপ্রিল কিশোরগঞ্জের তরাইল উপজেলার কোনাভাওয়াল গ্রামে মরিয়ম আক্তার পিংকি (১৬) নামে এক কিশোরীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বখাটেরা।
চলতি বছরের গত ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ছাত্রলীগ ক্যাডারের হাতে লাঞ্ছিত হয় ছাত্রীরা। গত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সামনে এক ছাত্রীকে কটূক্তির প্রতিবাদ করায় তার অভিভাবকদের পিটিয়ে যখম করা হয়েছে।
চলতি বছরের ১২ অক্টোবর নাটোর জেলার বাগতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজ রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান মিজান কলেজের ছাত্রীদের দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় স্থানীয় বখাটে যুবক আসিফ ও রাজন লোহার রড দিয়ে তাকে পিটিয়ে আহত করে। গত ২৫ অক্টোবর মিজানুর রহমান মিজান হাসপাতালে মারা যান।
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলা সদরের গাঁড়াখোলায় দশম শ্রেণীতে পড়া দুই মেয়ে হীরা ও মুক্তাকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বখাটে দেবাশীষ সাহা রনি ও তার সঙ্গীরা গত ২৬ অক্টোবর দুই ছাত্রীর মা চাঁপা রানী ভৌমিকের (৪৮) ওপর মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে তাকে হত্যা করে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ৪ জন বখাটের হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ বছরের কিশোরী আনিজা আক্তার বখাটের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া একজন শিক্ষক, কিশোরীর মা এবং একজন মহিলার স্বামী বখাটেদের অত্যাচারে প্রতিবাদ করায় বখাটেরা তাদের হত্যা করে। অক্টোবরে ১৯ ব্যক্তি নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় বখাটেদের আক্রমণে আহত হন।
নভেম্বর মাসে বখাটেদের দৌরাত্ম্যে ৩ কিশোরী আত্মহত্যা করে। ২ পুরুষ বখাটেদের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাদের হাতে নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়। গত ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার রায়পুর উপজেলার নিঝুড়ি গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রূপালীকে একই এলাকার সুশীল চন্দ্র মণ্ডল জোরপূর্বক ধরে নিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। এ ঘটনায় রূপালী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।
গত ৩ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে তাসলিমা (২৮) নামের এক গৃহবধূর আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে কন্যাসন্তান ধারণ করার খবর পেয়ে স্বামী সোহেল ও তার পরিবারের সদস্য ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তাসলিমাকে হত্যা করে।
চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর নিজ মেয়েকে উত্ত্যক্ত করায় বখাটেদের বাধা দেয়ায় মনির সরকার নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে বখাটেরা।
গত ২৩ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে মাত্র ৬ বছরের মনিরা বখাটেদের পাশবিকতার শিকার হয়ে মারা যায়। ছোট্ট এই শিশুটিকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শ্লীলতাহানি : অধিকারের রেকর্ড অনুসারে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪১৪ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩৬, ফেব্রুয়ারিতে ৩০, মার্চে ৫৬, এপ্রিলে ৬৩, মে মাসে ৫১, জুনে ৫৫, জুলাইতে ৫১, আগস্টে ৪২, সেপ্টেম্বরে ৫৫, অক্টোবরে ৪৭ ও নভেম্বরে ৩৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়। চলতি বছরের গত ১৪ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় রানীনগর গ্রামের দুই সন্তানের জননীকে ধর্ষণ করেছে বড়হর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বাবু ও তার সহযোগীরা।
গত ২৪ এপ্রিল পশ্চিম লালমোহনের চরউমেদ ইউনিয়নের কচুয়াখালী গ্রামের সফি মাঝির স্ত্রী ও মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে আওয়ামী লীগ কর্মী সিরাজ, সাইফুল, সোহাগ, আবদুল ও জুয়েল। গভীর রাতে বিএনপি কর্মী সফি মাঝির বাড়িতে ঢুকে তাকে বেঁধে সাইফুল ও জুয়েল তার মেয়ে মাদ্রাসা পড়ুয়া নবম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। এ সময় তার স্ত্রী মেয়েকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকেও ধর্ষণ করে সোহাগ ও আবদুল। গত ২৬ এপ্রিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাচড়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের এক বিএনপি নেত্রীকে গণধর্ষণ করে স্থানীয় যুবলীগ ক্যাডার রাকিব, সফিউল্লাহ, সোহেল, নজু, আব্বাস ও আল-আমিনসহ একদল অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত। গত ১৭ মে কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার আলিয়ারা গ্রামে এক প্রতিবন্ধী তরুণী গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকা দিতে গেলে ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমান তাকে ধর্ষণ করে।
গত ৫ জুলাই টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর উপজেলার কাহারতা গ্রামের নবম শ্রেণীর এক কিশোরী বাজারে কাগজ কিনতে গেলে উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুল্লা ইতিহাস ওরফে হাবিব, ছাত্রলীগ নেতা আরিফ আহমেদ ও সখিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত শিকদারের ভাগ্নে বাবুল আজাদ ও তার নাতি আরিফুল ইসলাম আকাশ এক কিশোরীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করে। গত ২১ নভেম্বর হবিগঞ্জ বাহুবল উপজেলার রূপসংকর (বানিয়াগাঁও) গ্রামে ইউপি চেয়ারম্যান ডা. রমিজ আলীর বাড়িতে সুমি আক্তার নামে এক কিশোরীকে একদল দুর্বৃত্ত ধর্ষণের পর হত্যা করে।
যৌতুক সহিংসতা : চলতি বছরও যৌতুকের সহিংসতা অব্যাহত ছিল। অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যৌতুক সহিংসতার ৩৫৪টি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৭, ফেব্রুয়ারিতে ২৭, মার্চে ২৪, এপ্রিলে ৩৬, মে মাসে ২৫, জুনে ৪০, জুলাইয়ে ৩৮, আগস্টে ৪৯, সেপ্টেম্বরে ৩১ ও অক্টোবরে ২৬টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া দৈনিক আমার দেশ-এ ডিসেম্বর মাসে যৌতুক সহিংসতার ২৫টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ সময় বহু নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে।
গত ২২ মে যৌতুকের জন্য অগ্নিদগ্ধ সীমা নামে এক গৃহবধূ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে। যৌতুকের দাবি পূরণ না করায় গত ২৮ এপ্রিল ঘুমন্ত সীমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় নেশাগ্রস্ত স্বামী দেলোয়ার হোসেন। নিহত সীমার বাড়ি রংপুরের মুন্সীপাড়ায়। ১৬ সেপ্টেম্বর যৌতুক না পেয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আমেনা আক্তার অ্যানি নামে এক গৃহবধূর মাথা তার স্বামী ন্যাড়া করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৮ এপ্রিল ঘুমন্ত সীমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় স্বামী দেলোয়ার হোসেন।
এসিড সহিংসতা : বছরজুড়েই ছিল এসিড সহিংসতা। প্রথম ১১ মাসে ১২৩ জন এসিড নিক্ষেপের শিকার হন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১৩ জন এসিডদগ্ধ হয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫, মার্চে ২৩, এপ্রিলে ৬, মে মাসে ৭, জুনে ৯, জুলাইয়ে ১৩, আগস্টে ১৫, সেপ্টেম্বরে ৯, অক্টোবরে ১০ ও নভেম্বরে ৪ জন এসিডদগ্ধ হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ডিসেম্বরে আরও ৬ জনকে এসিডে ঝলসে দেয়ার খবর আমার দেশ-এ ছাপা হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলার প্রতাপপুর গ্রামে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় শামসুল আলম নামে এক সেনা সদস্য একই গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকের স্ত্রী রাজিয়া এবং তার দুই মেয়ে রেহেনা ও রিমাকে এসিড দিয়ে ঝলসে দেয়। গত ৩ মে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার ইলিশপুর গ্রামে তরুণ পারভীন নামে একজন গৃহবধূ তার স্বামী আসাদুল ইসলামের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে তালাক দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ৯ মে আসাদুল ইসলাম, তার ভাই এমদাদুল ইসলাম ও প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয় দুর্বৃত্ত পারভীনের শরীরে এসিড ঢেলে দেয় এবং মশারি দিয়ে জড়িয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় তরুণ পারভীনকে খুলনা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনি সেখানে মারা যান
।