Tuesday 28 December 2010

কুয়াকাটায় চলছে হাঙর শিকারের উত্সব : প্রশাসন নীরব, পরিবেশে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা



মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)


কুয়াকাটা সমুদ্রবক্ষে চলছে অবাধে হাঙর শিকার। গত এক মাস ধরে চলছে লাখ লাখ ছোট ছোট হাঙর শিকারের উত্সব। হাঙর শুঁটকি লাভজনক হওয়ায় জেলেরা হাঙর শিকারে উত্সাহী হয়ে উঠেছেন। কুয়াকাটা শুঁটকিপল্লীতে হাঙরের শুঁটকির জন্য অতিরিক্ত মাচা তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চা বা জাটকা হাঙর শিকারে হাঙর প্রজাতির বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হলেও সরকারিভাবে এই বেপরোয়া হাঙর নিধন বন্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এতে সামুদ্রিক পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার কুয়াকাটা সৈকতের শুঁটকিপল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকিপল্লীর শুঁটকির মাচায় ৮-৯ ইঞ্চি সাইজের হাজার হাজার হাঙরের বাচ্চা কেটে শুকানো হচ্ছে। গত এক মাস ধরে সাগরবক্ষে লাখ লাখ হাঙর ধরা পড়ায় শত শত জেলে অন্য মাছ শিকারের পরিবর্তে শুধু হাঙর শিকারের মহোত্সবে নেমেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা শত শত ট্রলারে হাঙর বোঝাই করে শুঁটকিপল্লীতে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। রাত ১০-১২টা পর্যন্ত চলে হাঙর বেচাকেনা। এরপর সারারাত ধরে চলে হাঙর কেটে মাচায় শুকানোর প্রক্রিয়া। হাঙর শুঁটকি করতে ৩ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে বলে শুঁটকি শ্রমিকরা জানান।
সাগরে মাছ শিকার করে আসা জেলে সোলায়মান জানান, ‘সাগরে অ্যাহন কোলা হাঙর (হাঙরের বাচ্চা) ছাড়া তেমন কোনো মাছ পাওয়া যায় না। আইজ সকালে সাগরে যাইয়া আড়াই হাজার কোলা হাঙর পাইছি।’ জেলে আব্বাস মিয়া জানান, ‘এইবার সাগরে অনেক হাঙর ধরা পড়ছে। গতবার এত হাঙর ছিল না। ৮-৯ ইঞ্চি থেকে ৩-৪ ফুট সাইজেরও হাঙর ধরা পড়ছে।’ একাধিক জেলে জানান, হাঙর শিকারের জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করেন। হাঙর শীতকালে বেশি ধরা পড়ে। সমুদ্রের তলদেশে পানির তাপমাত্রা কমে গেলে হাঙর ঝাঁক বেঁধে পানির উপরিভাগে চলে আসে খাদ্যের সন্ধানে। তখন বিশেষ এক ধরনের জাল (লাক্কাজাল) দিয়ে হাঙর ধরা হয়। সাগরের ১৫-২০ কিলোমিটার গভীরে জোয়ারের সময় বেশি হাঙর ধরা পড়ে। সাগর থেকে উত্তোলনের ৫-৭ ঘণ্টা পর্যন্ত হাঙর জীবিত থাকে। বাচ্চা হাঙরও ৩-৪ ঘণ্টা টিকে থাকে। তাই গভীর সমুদ্র থেকে ট্রলার চালিয়ে উপকূলে আসতে পচে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকায় জেলেরা হাঙর শিকারের জন্য বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং হাঙর শিকারের জন্য অতিরিক্ত বরফেরও দরকার হয় না, যা অন্য মাছের জন্য দরকার।
শুঁটকি ব্যবসায়ী নুরুল হক (৪০) জানান, ছোট হাঙর একশ’টি ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায় ক্রয় করছেন। এদের সাইজ এতই ছোট যে প্রতিকেজিতে ১৫-২০টি হাঙর উঠছে। আর বড় হাঙর কিনছেন প্রতিমণ ৬-৭ হাজার টাকায়। এ হাঙর শুঁটকি করে প্রতিমণ ৮-১০ হাজার টাকায় তারা বিক্রি করছেন চট্টগ্রাম, ঢাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে।
একাধিক শুঁটকি ব্যবসায়ী জানান, হাঙরের শরীরের বিভিন্ন অংশ সেট হিসাবে বিক্রি করা হয়। হাঙরের কান, দাঁত, পাখনা ও তেল আলাদা বিক্রি করা হয়। হাঙরের কান প্রতিমণ ২২ থেকে ২৪ হাজার টাকা, তেল প্রতিমণ ৬ হাজার টাকা ও দাঁত প্রতিমণ ৭-৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়। হাঙরের শুঁটকি বাঙালিরা না খেলেও বিদেশে এগুলোর চাহিদা ব্যাপক। তবে বর্তমানে যেরকম লাগামহীনভাবে হাঙর শিকার করা হচ্ছে তাতে সাগরে অন্য মত্স্যসম্পদে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশিষ্টজনরা।
জেলা মত্স্য অফিস সূত্র জানায়, হাঙর শিকার বন্ধে এখনও কোনো আইন না থাকায় তারা হাঙর শিকার রোধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তবে হাঙর শিকার রোধে শিগগিরই একটি নীতিমালা চূড়ান্ত হচ্ছে বলে তারা জানান।
কলাপাড়া এমবি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞানের প্রভাষক এনামূল কবির লিটু জানান, হাঙর মাংসাশী প্রাণী। শীতকালে প্রজনন শেষে হাঙর খাদ্যের সন্ধানে সমুদ্রের উপরিভাগে চলে আসায় শিকারিরা সহজেই হাঙর শিকার করতে পারেন। তবে ছোট হাঙর শিকার করলে সমুদ্রে অন্য মত্স্য সম্পদে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কলাপাড়া কোস্টগার্ডের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার আমিনুল ইসলাম আমার দেশকে জানান, হাঙর শিকার বন্ধে তাদের কোনো নির্দেশনা না থাকায় এ ব্যাপারে তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না

No comments:

Post a Comment