Friday 31 December 2010

২৮ জনের আত্মহনন : পাঁচ অভিভাবক খুন

নাছির উদ্দিন শোয়েব

২০১০ সালে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল ইভটিজিং নামে যৌন অপরাধ। এসব অপরাধ গুরুতর হলেও এগুলো লোকমুখে ইভটিজিং নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ইভটিজিংয়ের ঘটনায় খুন-খারাবি, অভিভাবকের ওপর হামলা ও তরুণীদের হাত-পা কেটে নেয়ার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটেছে। বখাটেদের বেপরোয়া আচরণ ও নারীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতায় সারাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নিলেও বখাটেদের তত্পরতা বন্ধ করা যায়নি। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও বখাটেদের রোষানলে পড়েছে। তাদের হামলায় নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান এবং ফরিদপুরে হয়রানির শিকার এক কিশোরীর মা চাঁপা রানী ভৌমিকের মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অপরাধ দমনে র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাঠে নামানো হয়। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। পরে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে সারাদেশে এ অপরাধ প্রতিরোধ করার কার্যক্রম চালু করা হয়।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্ততার শিকার হয়ে ২৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫ অভিভাবক খুন হয়েছেন এবং বখাটেদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ১৮ জন তরুণী। ইভটিজিং প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ সময় ঢাকায় একজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতকে আটক করে সাজা দিয়েছে। একটি মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যমতে, মে মাসে ইভটিজিংয়ের শিকার ১৩ , জুনে ২৭, জুলাইয়ে ৩১, আগস্টে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮-এ। আর সেপ্টেম্বরে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ জন, যা ছিল রেকর্ড। র্যাবের হিসাবমতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে ১৩৮ জন কিশোরী ও তরুণী এবং গ্রেফতার হয়েছে ১২৬ জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৫ ভাগ ইভটিজার সমাজবিরোধী, দুর্বৃত্ত; ৩২ ভাগ স্কুল-কলেজগামী ছাত্র ও ৩৩ ভাগ ইভটিজার মধ্যবয়সী।
অধিকারের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান বলেন, নারীর প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতি, নারীর অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্বল প্রশাসন ইত্যাদি কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। ভিকটিম নারী বিচার না পাওয়ায় অপরাধীরা উত্সাহিত হচ্ছে ও সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী নির্যাতন এবং ইভটিজিং একই ধরনের অপরাধ নয়। ইভটিজিং বলতে ছোটখাটো তিরস্কার, অশালীন মন্তব্য, টিককারি ও অঙ্গভঙ্গি বুঝায়। কিন্তু ইদানিং হত্যাকাণ্ডসহ লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। প্রতিরোধে এগিয়ে আসায় তরুণী ও তার অভিভাবকরা খুন হচ্ছেন। নারী উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় যেখানে খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে সে ঘটনাকে শুধুমাত্র ইভটিজিং বলে চালিয়ে দেয়া হলে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি নাও হতে পারে। এ জন্য আইনের ধারাটি আরও কঠিন না হলে অপরাধীরা আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে যেতে পারে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেয়া সাজার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তারা ভয়ঙ্কর অপরাধ করতে পারে। একই সঙ্গে এর প্রতিরোধে সবাইকে সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ইভটিজিং প্রতিরোধে গত ২ নভেম্বর সারাদেশে হাই অ্যালার্ট জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধের শিকার কিশোরী, তরুণী ও নারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও সরকারকে নির্দেশ দেন তারা। পরে গত ১০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, বখাটে নারী উত্ত্যক্তকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মোবাইল কোর্টকে। তিনি আরও জানান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অন্যান্য আইনের সঙ্গে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে ইভটিজার বখাটেদের রুখতে এ আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্ত্যক্তকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উত্ত্যক্ত করা রোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মল্প্পণালয়ে তিন দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছে আইন কমিশন। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য একটি আইন করা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারা সংযোজন এবং দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারার স্পষ্ট ব্যাখ্যা রাখার কথা বলা হয়েছে। উত্ত্যক্ত করা বা যৌন হয়রানি বন্ধে নতুন করে আইন করতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তাই বিদ্যমান ২০০৩ (সংশোধিত) সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য যে আইন রয়েছে তার কিছু ধারা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আসামিরা যেন সহজে ছাড় না পায় ও শাস্তির মেয়াদ যেন বেশি হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে আইনটি করা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশে কোনো মন্তব্য করে, কোনো অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে যা ওই নারী শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা ওই নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তির বিনাশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ ১ বছর পর্যন্ত হতে পারে। অথবা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। মন্ত্রণালয় জানায়, এ আইনে নারীর শালীনতার অমর্যাদা বলতে কি বোঝায়, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।’ এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৫০৯ ধারাকে মোবাইল কোর্টে সংযুক্ত করে বিভিন্ন স্থানে সীমিত পরিসরে মোবাইল কোর্টের অভিযান শুরু হয়। কিন্তু বখাটেদের উপদ্রব কতটুকু কমেছে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।
গত মাসে ঢাকায় এক শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে আটক করে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় ঢাকা ছাড়াও ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, বাগেরহাট, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, সরাইল, ভৈরব, ঈশ্বরদী, হাকিমপুর, বগুড়া, পাবনা ও কাপাসিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত যুবককে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি বখাটের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ঢাকায় নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাসপিয়া আকন পিংকি আত্মহত্যা করে। ৩ এপ্রিল বখাটের হাতে উত্ত্যক্ত হয়ে ঢাকার খিলগাঁও থানার নন্দীপাড়া এলাকায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরা (১৪) আত্মহত্যা করে। ৫ এপ্রিল কিশোরগঞ্জের তারাইল উপজেলার কোনাভাওয়াল গ্রামে মরিয়ম আক্তার পিংকি (১৬) নামে এক কিশোরীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বখাটেরা। ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ছাত্রলীগ ক্যাডারের হাতে লাঞ্ছিত হয় ছাত্রীরা। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সামনে এক ছাত্রীকে কটূক্তি করার প্রতিবাদ করায় তার অভিভাবকদের পিটিয়ে যখম করা হয়েছে। ১২ অক্টোবর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজ রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান মিজান কলেজের ছাত্রীদের দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় স্থানীয় বখাটে যুবক আসিফ ও রাজন লোহার রড দিয়ে তাকে পিটিয়ে আহত করে। ২৫ অক্টোবর মিজানুর রহমান মিজান হাসপাতালে মারা যান।
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলা সদরের গ্যাঁড়াখোলায় দশম শ্রেণীতে পড়া দুই মেয়ে হীরা ও মুক্তাকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বখাটে দেবাশীষ সাহা রনি ও তার সঙ্গীরা ২৬ অক্টোবর দুই ছাত্রীর মা চাঁপা রানী ভৌমিকের (৪৮) ওপর মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে তাকে হত্যা করে। অক্টোবরে বখাটেদের হাতে ৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ বছরের কিশোরী আনিজা আক্তার বখাটের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া একজন শিক্ষক, কিশোরীর মা এবং একজন মহিলার স্বামী বখাটেদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় বখাটেরা তাদের হত্যা করে। অক্টোবরে ১৯ ব্যক্তি নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় বখাটেদের আক্রমণে আহত হন। নভেম্বর মাসে বখাটেদের দৌরাত্ম্যে ৩ কিশোরী আত্মহত্যা করে। ২ পুরুষ বখাটের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাদের হাতে নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়। ১ নভেম্বরে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়পুর উপজেলার নিঝুড়ি গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রূপালীকে একই এলাকার সুশীল চন্দ্র মণ্ডল জোরপূর্বক ধরে নিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। এ ঘটনায় রূপালী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। ৪ ডিসেম্বর বরগুনা সদর উপজেলার ঘটবাড়িয়া গ্রামে কলেজছাত্রী সুমা আক্তারের এক পা কেটে নেয় বখাটেরা। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিত্সার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।

No comments:

Post a Comment