Saturday 26 May 2012

সাংবাদিক পেটানোয় ৯ পুলিশ বরখাস্ত, কমিটি গঠন Sat 26 May 2012 8:22 PM BdST
ঢাকা, ২৬ মে (রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম)-- রাজধানীর আগারগাঁওয়ে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার তিন ফটোসাংবাদিককে পেটানোর ঘটনায় পুলিশের এক এসআইসহ ৯ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে এক সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এছাড়া শেরেবাংলা নগর থানার তেজগাঁও অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলামকে ক্লোজ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। তেজগাঁও জোনের ডিসি ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। দেশের বিভিন্ন স্থানে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় শনিবার দুপুরে আগারগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এ সময় দায়িত্ব পালনকালে প্রথম আলোর তিন আলোকচিত্রীকে বেদম মারধর করে পুলিশ। আহতরা হলেন- খালেদ সরকার, সাজিদ হোসেন ও জাহিদুল করিম। তাদের পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার ইমাম হোসেন বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিকদের) চাওয়া মতো অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানা যাবে।’ বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম, সহকারী উপপরিদর্শক শফিকুর রহমান ও নাজমুল ইসলাম, কনস্টেবল মতিউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, মো. শাহজাহান, মো. জয়নাল, রতন ও জাহাঙ্গীর। এদিকে, ডিএমপির গণসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, ‘সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শাহাবুদ্দিন কোরেশিকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ এদিকে, পুলিশের পিটুনিতে আহত প্রথম আলোর তিন ফটোসাংবাদিককে উন্নত চিকিৎসার জন্য পঙ্গু হাসপাতাল থেকে রাজধানীর ট্রমা সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়েছে। শনিবার সন্ধায় তাদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া, এই ঘটনায় প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। এদিকে, ডিএমপির গণসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, ‘সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শাহাবুদ্দিন কোরেশিকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ পুলিশের হামলায় আহত ফটোসাংবাদিক সাজিদ হোসেন জানান, পলিটেকনিক মহিলা কলেজে ছাত্রীদের মিছিলে ছবি তুলতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বাধা দেয়ার কারণ জানতে চাই। এ সময় পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এর এক পর্যায়ে পুলিশ মারধর শুরু করে। এ হামলায় ডিএমপির তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শহিদুল ইসলাম নেতৃত্ব দেন বলে জানান তিনি। সাজিদ আরো বলেন, সাংবাদিক পরিচয় দিলেও শহিদুল উত্তেজিত হয়ে নিজেকে সাংবাদিকের বাপ দাবি করে বলেন, ‘আমি অনেক সাংবাদিক দেখেছি, অনেক সাংবাদিক মেরেছি তুই কে?’ তিনি আরো জানান, ‘এরপর শহিদুল আমাদের পুলিশের অস্ত্র ছিনতাইয়ে মামলা দেয়ার জন্য তার সহোযোগিদের নির্দেশ দেন এবং আমাদের ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে শেরেবাংলানগর থানায় নিয়ে আসেন।’ সাজিদ বলেন, ওই সময়ে আমাদের আরো তিন ফটো সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থতি ছিলেন। তারা আমাকে বাঁচাতে এলে তাদেরও পুলিশ বেধড়ক পেটায়। একই ঘটনায় আহত সাজিদের অপর সহকর্মী সাংবাদিক জাহিদুল করিম বলেন, মিছিলে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ মা-বাবাকে তুলে গালি গালাজ করতে থাকে। এ সময় সাজিদ গালিগালাজ করার কারণ জানতে চায়। এটা বলার পরেই কিল ঘুষি-লাথি আর বেধড়ক লাটিপেটা করে রক্তাক্ত করে দেয়। রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম/এইচএ/এমআই_ ২০২১ ঘ.

Friday 25 May 2012

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন শেখ হাসিনা দেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতের হাতেই চাবিকাঠি নয়া দিগন্ত ডেস্ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্ট। গতকাল শুক্রবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে রাজনৈতিক উত্তেজনা, দুর্নীতি, খুন, অপহরণ ইত্যাদি বিষয় তুলে দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ’স টক্সিক পলিটিকস : ইট ইজ আপ টু ইন্ডিয়া টু ট্রাই টু স্টপ শেখ হাসিনা রুইনিং বাংলাদেশ’। অপরটির শিরোনাম ছিল ‘পলিটিকস ইন বাংলাদেশ : দ্য প্রাইম মিনিস্টার সেটস দ্য কান্ট্রি অন অ্যা ডেঞ্জারাস পাথ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হতে প্রায় ১৮ মাস বাকি থাকতেই রাজপথে বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। বিরোধী নেতাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, তাদের গুম ও খুনের জন্য ক্ষমতার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচন কার তত্ত্বাবধানে হবে এবং তা আসলেই নিরপেক্ষ হবে কি না তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এটা ইতোমধ্যে এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, অনেক পর্যবেক্ষক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশীরা ইতোমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য, মারাত্মক লোডশেডিং এবং নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ুব্ধ হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা বেগম খালেদা জিয়া অন্যায় আচরণের জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন। এতে বলা হয়, মাস খানেক আগে এক তরুণ রাজনীতিবিদকে অপহরণ করা হয়, খুব সম্ভবত তাকে খুন করা হয়েছে। এর আগে অন্য দু’জনকে হত্যা করা হয়। চলতি মাসে সিনিয়র কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ৩৩ জন বিরোধী নেতাকে কারাগারে ঢোকানো হয়। খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির তিন হাজার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এটা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আরো অনেক কলঙ্কিত বিষয় রয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এক সৌদি কূটনীতিক গুলিতে নিহত হয়েছেন, এক ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী নির্যাতিত ও খুন হয়েছেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান করার পর এক সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকায় মোটরসাইকেলে গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তা এই সাংবাদিকের পিছু নিয়েছিল। সেনাবাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে জানুয়ারিতে ক্যুর গুজব ছড়ানো হয়। বাংলাদেশের অন্যতম সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গ্রামীণ ব্যাংকের মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্তা করা হয়েছে। মতিভ্রমের শিকার শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন। চলতি মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন ঢাকায় তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন। এতে অবশ্য স্বস্তিদায়ক অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। মন্ত্রীরা তার সমালোচনা করছেন আর সরকার তার ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য আরেক দফা কমিশন গঠন করেছে। আর কমিশন গঠন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউনূস। বস্তুত সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে কব্জা করতে চাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি এত ব্যাপক যে, তা দাতাদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাপান তার উপ-প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি ব্যক্ত করেছে। সাম্প্রতিক এক দুর্নীতির ঘটনায়, রেলমন্ত্রীর সহকারীর গাড়ি থেকে বস্তাভর্তি টাকা পাওয়ার পরে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু অল্প পরেই তাকে মন্ত্রিসভায় পুনর্বহাল করা হয়। এ দিকে গণতন্ত্র নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলতি সপ্তাহে হিলারি কিনটনের হুঁশিয়ারি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন অবশ্যই ‘অংশগ্রহণমূলক’ হতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে নিরপেক্ষভাবে, যাতে বিরোধী দল অংশ নিতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ভারতের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত ইসলামি চরমপন্থী এবং ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের দমন, বাণিজ্য উদারীকরণের প্রশংসা করে আসছিল। ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সম্ভবত একটি পক্ষের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করেছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি দিল্লির গ্রীষ্মের গরমের পরে সেখানে যাবেন। খালেদা জিয়া প্রতিবেশী দেশটিকে ‘বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এটা তার দলের অবস্থানগত পরিবর্তনের সূচক হতে পারে। শেখ হাসিনাকে যত একরোখা মনে হচ্ছে, জনগণ তত তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য সব দোষের জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করা যায় না। তবে তিনি সংবিধান পাল্টে দিয়েছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ইতঃপূর্বে তিনি আন্দোলন করেছিলেন, সেটাই এখন বাদ দিয়েছেন। তিনি সম্ভবত আগামী নির্বাচনে আরো ভালোভাবে জয়ের বিকল্পগুলো খোলা রাখতে চাচ্ছেন। অন্য দিকে খালেদা জিয়া রাজপথে বিক্ষোভ ও অনশন করছেন এবং জুনে গণ-আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। এর দুঃখজনক পরিণাম হবে রাজনীতিতে আরো মেরুকরণ এবং সঙ্ঘাত সৃষ্টি। ইকোনমিস্টের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বহির্বিশ্ব কিছুটা চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে এসেছে, ইউনূসের প্রতি অসদাচরণ ও হয়রানিমূলক তৎপরতার নিন্দা করেছেন ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রদূতেরা। ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানাতে হিলারি কিনটন চলতি মাসে ঢাকা এসেছিলেন। কিন্তু সরকারকে অনড় মনে হচ্ছে। হিলারির প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করতেই যেন সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করছে, এর মাধ্যমে ব্যাংকটির মালিকানা সরকার নেবে কিংবা ধ্বংসও করে ফেলতে পারে। ঢাকার ওপর একমাত্র যে দেশ অনেক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে সে হলো ভারত। ইসলামপন্থীদের দমন করার কারণে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত শেখ হাসিনার বাড়াবাড়ি সহ্য করেছে। ভারত এখন উভয় দলের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায় বলে মনে হচ্ছে। ভারত যদি তার প্রতিবেশী দেশটিতে কার্যকর গণতন্ত্র দেখতে চায়, তবে তাকে আরো বলিষ্ঠভাবে এর পক্ষে কথা বলতে হবে। http://www.dailynayadiganta.com/details/48707
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে তোলপাড় বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের জন্য ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ নয়া দিগন্ত ডেস্ক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন নিয়ে দেশে তোলপাড় চলছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, এতে তাদের অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্য দিকে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, এ রিপোর্টে তারা উদ্বিগ্ন নন। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এই প্রতিবেদন দেশে ঘটমান বাস্তবতার প্রতিফলন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে রাজনীতিকরণ করে বিরোধী দলের সদস্যদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারসংক্রান্ত সমস্যাবলির সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন; সামাজিক সহিংসতা, নারীদের প্রতি বৈষম্য; সামাজিক সহিংসতা থেকে আদিবাসী লোকদের রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতা। অন্যান্য মানবাধিকার সমস্যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুম, হেফাজতে মৃত্যু, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটকসহ ক্ষমতার অপব্যবহার। কারাগারের অবস্থা অনেক সময় জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ, বিচার-পূর্ব দীর্ঘ দিন আটক থাকাও বড় সমস্যা। বিপর্যস্ত বিচারব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতিকরণ করে এর সমস্যা আরো বাড়ানো হয়েছে এবং বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। সরকার যে কথা বলার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করেছে, তার অনেক ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়া স্ব-সেন্সরশিপও বহাল রয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী সাংবাদিকদের হয়রানি অব্যাহত রেখেছে। সরকার সমাবেশ করার স্বাধীনতা খর্ব করেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা এখনো সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সরকারিপর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি এখনো একটি মারাত্মক সমস্যা। এতে বলা হয়, দায়মুক্তি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই, বিশেষ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দায়মুক্তির আওতায় কাজ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার ব্যাপকভিত্তিক কোনো তদন্ত করে না। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিজিবি) ও র‌্যাব প্রায়ই কর্তৃত্ববহির্ভূত ভয়ঙ্কর শক্তি প্রয়োগ করে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারমূলক অনেক কাজের অভিযোগ রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কতজন নিহত হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করেনি। এসব ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার ব্যাপকভিত্তিক কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। মিডিয়া রিপোর্ট, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সরকারি সূত্রের তথ্যানুযায়ী ২০১১ সালে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৬৮। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, গত বছর নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেছে ২১৬ জন। সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশী নিহত হওয়ার ঘটনা এখনো সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, গত বছর ৩১ জন নিহত হয়েছে; আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৫৮। উদাহরণ হিসেবে ১৫ বছর বয়সী ফালানী খাতুনের কথা বলা যেতে পারে। সীমান্ত অতিক্রমের সময়ে ভারতীয় বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। ভারতীয় বাহিনী তার লাশ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার আগে ফালানী ১৫ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় পড়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে গুম, অপহরণ বেড়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ঠিক কতজন এ অবস্থার শিকার, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অপহরণের কয়েকটি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব মতে, গত বছর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অপহরণের ৩০টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯। অধিকারের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে অন্তত ৪৬ জনের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন চালিয়েছে। সরকার বলতে গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এর মধ্যে মানবাধিকার অপরাধের অভিযোগে আটক বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। তার পরিবার এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে পুলিশ তা অস্বীকার করে। এ ছাড়া বিরোধী দল বিএনপির ডাকা হরতালে সংসদ সদস্য চিফ হুইফ জয়নুল আবদিন ফারুক পুলিশের হাতে নির্যাতিত হন। সংবিধানে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটকের বিরুদ্ধে বিধান থাকলেও কোনো পরোয়ানা ছাড়াই কর্তৃপক্ষ আইনবলে অপরাধমূলক তৎপরতায় জড়িত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারে। আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বিরোধী দলের হরতাল কালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সমালোচনা করেছেন। র‌্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদের দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র‌্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে। প্রত্যদর্শীরা বলছেন এবং রফিকুলের জামাতা পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, র‌্যাব অফিসাররা আটক করেছেন রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কাভার্ডভ্যানে তুলে নিয়েছে। এ সময় র‌্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্তু র‌্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়। এ দিকে ২০১০ সালের জুনে র‌্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন। প্রতিবেদনে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগের বেলায় পুলিশ সাধারণত অকার্যকর ও অনীহা থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দায়মুক্তি সুবিধা ব্যাপক। নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও সেটি প্রয়োগ করা হয় না। এতে ২০১০ সালের অক্টোবরে বিএনপির মিছিলে হামলা চালিয়ে নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে খুন করা হয়। খুনের দায়ে আটক ছাত্রলীগের ২৭ জনের সবাই জামিন পেয়ে যান। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বাবুকে পিটিয়ে হত্যা করছেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মামলাটি চলবে; কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি পরে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের কর্মীদের বলেন, এ ঘটনা নিয়ে ‘চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই’। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, দিনে দুই সহস্রাধিক লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই দু-এক দিন পরে ছাড়া পাচ্ছেন, ঘুষের বিনিময়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতার অভিযান চালায়। বিচার বিভাগ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনে আছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু সংবিধানের দীর্ঘ দিনের একটি অস্থায়ী বিধানের কারণে নির্বাহীরা নিম্ন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা বিচার বিভাগের নিয়োগ দেন। আইনের মাধ্যমে ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের নিয়োগে রয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় সরকার বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাদের জামিন ও আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত। ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের শপথ গ্রহণ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ওই সব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা জানান, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধিবিধান থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ করে না সরকার। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সাথে জড়িত। এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির মামলা ছিল, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই নির্বাহী আদেশবলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে; অথচ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা খুব কম মামলাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। বছরজুড়ে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আগের সরকারের আমলে দায়ের করা মামলাগুলোতে ক্ষমা মঞ্জুর করেন, যা দৃশ্যত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ক্ষমা পাওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তিই আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত। এসব ক্ষমার অনেকগুলো সুশীলসমাজের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার বিভাগে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। এতে বলা হয়, আগস্টে ডেইলি স্টারের এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বিস্তর টাকা গ্রহণ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী খারিজ করে দেয়া রায়ের পর খায়রুল হক ও হাইকোর্টের আরো কয়েকজন ওই তহবিল থেকে টাকা পেয়েছিলেন। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই অর্থ হস্তান্তর নিশ্চিত করেছে। আর খায়রুল হক জানান, ওই টাকা ব্যয় হয়েছে তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষের আইনজীবীর উদ্ধৃতি দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভীতি প্রদর্শন করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সমালোচনাকারী সংবাদপত্রগুলো সরকারি চাপের মুখে পড়ে। ফ্রিডম হাউজের ২০১০ সালের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মিডিয়া আংশিকভাবে মুক্ত। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দু’টি টেলিভিশন চ্যানেল (চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি) বন্ধ করে দেয়। উভয় চ্যানেল এখনো বন্ধ। সরকার রাজনৈতিক সমর্থকদের নতুন টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধীদের দেয়নি। এত বলা হয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এখনো মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কিত লোকদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি বেড়েছে। অধিকার ও মিডিয়া ওয়াচডক গ্রুপগুলোর মতে, গত বছর অন্তত একজন সাংবাদিক নিহত ও ১৩৯ জন আহত হয়েছেন, একজন গ্রেফতার হয়েছেন, ৪৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন, ৫৩ জন হুমকি পেয়েছেন এবং ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ছাত্র গ্রুপগুলোও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সরকার সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে না। সরকারের সমালোচক ও বিরোধীদের সাথে সম্পর্কিত সাংবাদিকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের নির্যাতন নেমে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০ মে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন একটি বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গিদের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রমাণ রয়েছে। সরকার চাইলে ওই সম্পাদককে গ্রেফতার করা যেতে পারে। সিদ্দিক ওই সম্পাদকের নাম প্রকাশ করেননি, কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। ৩১ জুলাই কর্তৃপক্ষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল শীর্ষনিউজের সম্পাদক একরামুল হককে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার করে। এ অভিযোগ বানোয়াট বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একরামুলের সংবাদ পরিবেশনের প্রতিশোধ হিসেবে এটি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সরকার শীর্ষনিউজের সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেয়নি। ফলে তাদের পক্ষে সরকারি খবর কভার করা সম্ভব হয়নি। পরিণতিতে সংবাদ সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। একরামুল হক জামিনে ছাড়া পেলেও তার মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। ১২ সেপ্টেম্বর র‌্যাব সদস্যরা বাংলাভিশনের ব্রডকাস্ট ইঞ্জিনিয়ারের ওপর হামলা চালায়। ক্ষমতাসীন সরকার দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। দেশে শতাধিক দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং একমাত্র সরকারি টিভি চ্যানেল বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) আছে। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিটিভি দেখে এবং সাধারণ জনগণ ৮০ শতাংশ তথ্য এ চ্যানেল থেকেই পায়। বিটিভিতে সরাসরি সংসদ ও সরকারি অনুষ্ঠান প্রচার করলেও বিরোধী দলের মতামত খুব কম প্রচার করা হয়। এমনকি বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার প্রায়ই বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকে সভা আয়োজন ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে বাধা দিয়ে থাকে। ২০১১ সালে সরকার বিরোধী গ্রুপগুলো সভা আয়োজন থেকে বিরত রাখতে বিশেষ আইন অন্তত ১৩৩ বার প্রয়োগ করেছে। অনেক সময় পুলিশ বা ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশ বানচাল করে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তারা ২০১১ সালে মিছিল বা সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের। সন্দেহভাজনদের পাসপোর্ট জব্দ করা না হলেও বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তারা বিরোধী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিবিদদের দেশ ত্যাগে বাধা দিয়ে থাকেন। গত বছর ৩০ জুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানে একটি সংশোধনী আনে। ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের অধীনেই ২০১৩ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই সংশোধনীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও নির্বাচন পর্যবেক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছরজুড়ে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থান চলেছে। আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপে নন বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশনে যাচ্ছে না। দুর্নীতি মোকাবেলার জন্য গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সরকার ২৩ ফেব্রুয়ারি একজন সাবেক আমলা ও একজন সাবেক বিচারপতিকে নিয়োগ করে। উভয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার দুদকের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। সরকারি একটি কমিশন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ দুদকের কার্যক্রমে সরকারের হস্তক্ষেপের উল্লেখ করে বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি ‘দন্তহীন বাঘে’ পরিণত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার দলের লোকদের মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করছে না http://www.dailynayadiganta.com/details/48706
মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে ভিয়েনা প্রবাসীদের উদ্বেগ Wed 23 May 2012 10:49 PM BdST
নিউজ ডেস্ক, ২৩ মে (রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম)-- বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে ভিয়েনা প্রবাসীরা। বিরোধী রাজনীতিকদের নির্বিচারে হয়রানি বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সামনে মুহাম্মদ আসাদ পার্কে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এ আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে মানবাধিকার সংগঠন ইউরো-এশিয়া হিউম্যান রাইট্‌স এ মানববন্ধন কর্মসূচি আয়োজন করে। মানববন্ধনে সমবেত বিভিন্ন কমিউনিটির নেতারা ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের চরম লংঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আজ দেশের সর্বক্ষেত্রে নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। নিবির্চারে রাজনৈতিক প্রতিক্ষকে ঘায়েল ও নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া, প্রতিনিয়ত একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মতো হত্যা, খুন ও গুম দেশে এক বিভিষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অন্যদিকে দেশের সীমান্তে গুলি করে পাখির মতো মানুষ হত্যা যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সাংবিধানিক অভিভাবক নির্বাচিত সরকারের নির্লিপ্ততার নিন্দা জানিয়ে বক্তরা বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানবিক গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়ার কাজে সরাসরি পুলিশ বহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার সামগ্রিক পরিস্থতিকে আরো জটিল করেছে। মানববন্ধন থেকে দেশের এ নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের সরকারকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার পাশপাশি এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহলকে যথাযথ ভূমিকা রাখার আহবান জানানো হয়। দেশের হত্যা, খুন ও গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে হত্যা,খুন ও গুমের মহোৎসবচলছে। প্রতিদিন পুকুর, ডোবা ও নালাতে গলিত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলেন, খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ঘটনা সরকার যেন ইচ্ছা করে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিবির নেতার সন্ধানে সরকার বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা প্রকাশ করেনি। ইউরো-এশিয়া হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডিয়াম সদস্য কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ড. রওনক আফজা, বাংলাদেশ অস্ট্রিয়া সমিতির সভাপতি নেয়ামুল বশির, বিএনপি অস্ট্রিয়া শাখার জেষ্ঠ্য নেতা আহসানুল শামস বাবু, বাংলাদেশি কমিউনিটি লিডার মোশাররফ হোসেন আযাদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ অস্ট্রিয়া সমিতির সেক্রেটারি আবু সাঈদ চোধুরী লিটন, আয়োজক সংগঠনের নেতা মুহাম্মদ ইব্রাহীম, হাবিবুররহমান জামাল, ফ্রি লিডার্স কাউন্সিলের আহবায়ক শামীম বেনোয়ার, হাফেজ মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মুহাম্মদ মুস্তফা, তাহমীদ বিল্লাহ, মুহাম্মদ হারুন, নজরুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, গাজী কামাল, আবু বকর সিদ্দীক, আহমেদ শিহাব উদ্দিন, বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী, মুহাম্মাদ হানিফ, পলাশ প্রমুখ। মানববন্ধন শেষে ইউরো-এশিয়া হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডিয়াম সদস্য রফিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ অষ্ট্রিয়া সমিতির সভাপতি নেয়ামুল বশিরের নেতৃত্বে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়। রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম/বিজ্ঞপ্তি/এসআই_ ২২৩৯ ঘ. http://www.real-timenews.com/details.php?id=47011&p=1&s=3
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/05/26/146813 মানবাধিকার রিপোর্টে তোলপাড় : রাষ্ট্রের উলঙ্গ শক্তি প্রদর্শনে সৃষ্টি হয়েছে নারকীয় অবস্থা : বিচার বিভাগ অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ হয়েছে : গুম ও হত্যার সংখ্যা বাড়ছে ভয়ঙ্কর হারে স্টাফ রিপোর্টার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাকে ‘বিভীষিকাময়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সরকারি বাহিনী বিপুলসংখ্যক নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। অনেক নাগরিককে গুম করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুসহ নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের উলঙ্গ শক্তি প্রদর্শনে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারদলীয় ক্যাডাররা। অবৈধভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার প্রতিদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাওয়ার পথও বন্ধ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ক্রমবর্ধমান এবং অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সরকারবিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বুধবার ও বৃহস্পতিবার রিপোর্ট তিনটি প্রকাশ করে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে নানা উপায়ে। নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, গার্মেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসহ প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরই নেমে এসেছে অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কড়া সমলোচনা করা হয়েছে এসব রিপোর্টে। বলা হয়েছে, এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এ অবস্থার অবসানের জন্য সরকার পরিবর্তনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থাকে বন্ধ করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়সক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। তার পরিবর্তে সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিধান সংযোজন করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার রিপোর্ট : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে সরকারবিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুুচিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি একটি মারাত্মক সমস্যা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, খেয়ালখুশিমত গ্রেফতার ও আটক রাখার জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তারক্ষীরা সাংবাদিকদেরও হয়রানি করছে। বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে সাতটি বিভাগে এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। স্বভাবতই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রলয়ের ওই রিপোর্টে মার্কিন সরকারের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। বিচার বিভাগ : বিচার বিভাগ সম্পর্কে ওই রিপোর্টে বলা হয়, আইনে আছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় তারা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত করা হয়েছে। ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ওইসব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা বলেন, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। বছরজুড়ে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে আগের সরকারের আমলে করা মামলা থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের রেহাই দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, ওইসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এক্ষেত্রে অনেক অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে সুশীল সমাজে। সরকারি বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও বাইরে থেকে প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটি সমস্যা। সরকারের দুর্নীতি : সরকারি কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও সরকার তার যথাযথ প্রয়োগ করে না। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘দন্তহীন বাঘ’ আখ্যা দিয়েছে। দুদক দুর্নীতি দমনে সিরিয়াস নয় এবং রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব মামলা হয়েছিল কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশের বলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গণমাধ্যম : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ চলছেই। নিরাপত্তা বাহিনী হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে। সরকারি দলের লোকজন সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে, তাদের নামে মামলা দিচ্ছে। যেসব সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করে তাদের সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী হয়রানি করে থাকে। সংবিধানের সমালোচনা করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ চ্যানেল ওয়ান ও যুমনা টিভি নামের দুটো টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়, যা ২০১১ সালে অনএয়ারে আসতে পারেনি। গুম ও নিখোঁজে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা : নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য সাধারণ ক্ষমার অধীনে কাজ করেন। এক্ষেত্রে র্যাবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই রিপোর্টে নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে বলা হয়, পুরো বছরে যেসব নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ আছে, তা ঘটিয়েছে বেশিরভাগই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ২০১১ সালে নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা বেড়ে যায়। কিন্তু এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে কতগুলো অপহরণ ঘটেছে রাজনৈতিক উদ্দেশে। কিছু অপহরণ ঘটেছে টাকার জন্য। আবার কিছু অপহরণ ঘটেছে স্থানীয় শত্রুতা থেকে। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর মতে, ৩০টি নিখোঁজের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। র্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদের দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি র্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রফিকুলের জামাই পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, র্যাব অফিসাররা আটক করেছে রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কভার্ডভ্যানে তুলে নেয়া হয়েছে। এ সময় র্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্ু্ত র্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়। ওদিকে ২০১০ সালের জুনে র্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : ওই রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব এ সময়ে অপ্রত্যাশিত শক্তি ব্যবহার করেছে। র্যাবের খেয়ালখুশিমত কার্যক্রমের ঘটনা অনেক। এতে বলা হয়েছে, র্যাব ও পুলিশসহ নিরাপত্তারক্ষীরা আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে। তারা প্রহার করছে। এমনকি বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জয়নুল আবদিন ফারুককে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১১ সালে পুলিশ হেফাজেত ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১১৬ জনই মারা গেছে কারাগারে থাকা অবস্থায়। সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে : মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখনও ভঙ্গুর। যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপেক্ষ নয় বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশনে নিয়মিত যাচ্ছে না। অ্যামনেস্টির মানবাধিকার রিপোর্ট : বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বুধবার রাতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির ২০১১ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গত বছর ৫৪ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। বিনা বিচারে আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। রিপোর্টে বলা হয়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১১ সালে অসংখ্য নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে মোট ৫৪ জনেরও বেশি মানুষকে র্যাব এবং পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে অন্তত ৭০০ জন। অবশ্য র্যাব সবসময় দাবি করে বলেছে, এনকাউন্টারেই এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে লিমন হোসেনের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, ১৬ বছর বয়সী লিমনকে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ র্যাব কর্মকর্তারা পায়ে গুলি করে। র্যাব কর্মকর্তারা তখন দাবি করে, সে একজন দুষ্কৃতকারী। র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলির সময় তার পায়ে গুলি লেগে থাকতে পারে। কিন্তু লিমন জানায়, সে ছিল একা। গরু নিয়ে বাড়িতে ফিরছিল। তখনই র্যাব সদস্যরা তাকে আটক করে পায়ে গুলি করে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি আজও। বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে অ্যামনেস্টি দাবি করেছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, আটক অবস্থায় পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। ২০১১ সালে অন্তত ৩ জন আটক অবস্থায় পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছে। এসব নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার এসব ঘটনা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলেও সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। আমার দেশ প্রকাশের বৈধ লাইসেন্স নেই বলে অভিযোগ তুলে পুলিশ দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মাহমুদুর রহমান ওই নির্যাতনের বর্ণনা আদালতে দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান জানান, ক্যান্টনমেন্ট থানায় পেছনে হাত বেঁধে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাকে এমনভাবে পেটানো হয় যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশের জন্যই মাহমুদুর রহমানের ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কড়া সমালোচনা : বিবিসি জানায়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে না। অ্যামনেস্টি ২০১১ সালে বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে এ বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক ত্রুটি ছিল, তার কিছু কিছু সংশোধন করা হলেও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে এবং এ ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে পারছে না। প্রতিবেদনটির বাংলাদেশ অধ্যায় নিয়ে অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে সরাসরি বলেছেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখনও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারেনি বলেই তারা মনে করেন। অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হলে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি যাদের বিচার করা হচ্ছে, তাদের মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজের কথায়, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি যাদের বিচার চলছে, তারা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন বা তারা যেন নির্যাতনের শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি।’ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে যে দেশের অন্য কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, এটি মানবাধিকারের জন্য একটি বড় সমস্যা বলে তিনি অভিহিত করেন। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতেও তিনি পরামর্শ দেন। ফয়েজ অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার অধিকার বিষয়টিও তোলেন এবং একই সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারীদের নিরাপত্তা বিষয়টির প্রতিও গুরুত্ব দেন। তবে ফয়েজ বলেন, জামিন পাওয়া বিষয়ে কিংবা সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার পর আদালতের বিধিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে—যা ইতিবাচক। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে আরও অনেক পরিবর্তন আনা দরকার বলে অ্যামনেস্টির অভিমত এবং তারা তাদের এ বক্তব্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন। ফয়েজ বিবিসিকে আরও বলেন, ‘অভিযু্ক্তদের আইনজীবীরা যথাযথ তথ্য পাচ্ছিলেন না। এখানে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা আসলে ঠিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, এসব ক্ষেত্রে আমরা মোটেই সন্তুষ্ট নই।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া অ্যামনেস্টি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান ফয়েজ। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটলে অ্যামনেস্টি আপত্তি জানাবে বলেও তিনি জানান। নারীর প্রতি সহিংসতা : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর মার্চে প্রকাশিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য চিকিত্সাসেবা, আইনি সহায়তা এবং কাউন্সিলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, কর্তৃপক্ষ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যৌন ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার অনেক নারী ও শিশু সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের হাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি দখল হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, পার্বত্য জেলাগুলোতে দু’পক্ষের সহিংস সংঘর্ষে সম্পত্তির ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বাধা না পেয়ে বাঙালিরা প্রায়ই পাহাড়িদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনেই এটা ঘটছে।’ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন : বাংলাদেশে হত্যা ও গুম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, আওয়াম লীগ সরকার মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের শর্ত পূরণ করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে এইচআরডব্লিউ। সরকার আইনে কিছু বিধিবিধান সংশোধন করলেও যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার মতো বিষয়গুলোর সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এখনও নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। বাংলাদেশ বিষয়ে এইচআরডব্লিউ’র বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পুলিশি নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেফতার, এমনকি গুমের নতুন নতুন অভিযোগও বাড়ছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত র্যাব সদস্যদের বিচার করার পরিবর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের ঘটনার কথা অস্বীকার করেছেন। ২০১১ সালে সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের দণ্ডিত করে এবং এনজিওগুলোর বৈদেশিক মঞ্জুরি বিলম্বিত করার মাধ্যমে সুশীল সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে একটি বিল প্রণয়নের কাজও চলছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নারী ধর্ষণ, যৌতুক সম্পর্কিত সন্ত্রাস, এসিড হামলা ও যৌন নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য একটি আইন তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নির্বিচার গ্রেফতার, নির্যাতন এবং হেফাজতে রেখে হত্যার ঘটনা অব্যাহত আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকার বিন্দুমাত্র সায় দেবে না। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত হয়নি এবং দায়ীদের কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে অন্তত ১৬০০ লোক র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সন্দেহভাজনদের ওপর নির্যাতন, নৃশংস ও অমানবিক শাস্তি অব্যাহত রেখেছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের বিচার ২০১১ সালেও অব্যাহত ছিল। সামরিক আদালতগুলোতে প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা প্রমাণ উপস্থাপনসহ বিচারের মানদণ্ড অগ্রাহ্য করে গণবিচারে প্রায় ১ হাজার জওয়ানকে দণ্ডিত করা হয়েছে। ২৭ জুনের একটিমাত্র বিচারে ৬৬৬ জন আসামির মধ্যে ৬৫৬ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আরও ৮৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের অনেকের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। বিডিআর বিদ্রোহের পর তদন্ত চলাকালেই ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা কোনো আইনজীবীর সহায়তা না-ও পেতে পারেন। শ্রমিক নেতাদের নিপীড়ন ও বিদেশি অনুদান বিলম্বিত করে নাগরিক সংগঠনগুলোর ওপর ২০১১ সালে নিন্ত্রয়ণ আরও কঠোর করেছে সরকার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ওপর সরকার নজরদারি বাড়িয়েছে, এর স্টাফদের হুমকি দেয়া হয়েছে এবং হয়রানি করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসকে বয়সের অজুহাত দেখিয়ে সরিয়ে দেয়ার পর তার অনুসারীদের হয়রানি করা হয়েছে।
পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না সরকার হারুন জামিল ও ফজলুল হক শাওন দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের কোনো পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারছে না সরকার। সরকারি দলের ভেতরে-বাইরে রয়েছে এ নিয়ে ক্ষোভ। অনেক সময় মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না সরকারি দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা। অর্থনৈতিক মন্দা, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, খুন, গুমের বিস্তার, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুৎ নিয়ে চরম দুরবস্থা এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য না পাওয়ার মতো হাজারো অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিস্তার, খুন, গুমসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতার ফিরিস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিচার বিভাগ দলীয়করণের কুফল সম্পর্কেও মন্তব্য করা হয়েছে রিপোর্টে। বলা হয়েছে, বিচার বিভাগে দলীয় লোক নিয়োগের ফলে জনগণের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের মান সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে রিপোর্টে। অন্য দিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এখন সরব আলোচনা চলছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ইকোনমিস্টের সবশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বর্তমান সরকার যে এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সঙ্কট এখন চরমে পৌঁছেছে। দেশটিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা হচ্ছে না। সরকারের নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে জনগণের মত প্রকাশের অধিকারও সীমিত হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে এসব প্রতিবেদনে। এমনিতেই বর্তমান সরকারের সময়কালে কাজের চেয়ে কথা হচ্ছে অনেক বেশি। সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের লাগামহীন বক্তব্য ও অতীতমুখী রাজনীতির ফলে দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়নি। প্রশাসন অদক্ষ ব্যক্তিদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে। শেষ মুহূর্তে অনেক প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের অসহিষ্ণুতা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এসবই সরকারের জন্য ক্রমান্বয়ে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি দলের মাঠপর্যায়ের নেতারা জানান, প্রতিনিয়ত তারা যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন তার জবাব দিতে না পেরে অনেক সময় তারা অভিযোগ নিয়ে ছুটছেন জেলাপর্যায়ে; কিন্তু জবাব মিলছে না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে জেলাপর্যায়ের নেতাদের প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানেও সন্তোষজনক জবাব মিলছে না। সক্রিয় নেতাকর্মীরাও এই ক্ষোভ ও হতাশায় এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় অংশ নেয়া মাঠপর্যায়ের জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত যেসব নেতার সাথে বৈঠক হয়েছে সব বৈঠকেই তৃণমূলপর্যায়ের ক্ষোভের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তাদের ক্ষোভের প্রধান কারণ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। নতুন লাইনের সংযোগ প্রায় বন্ধ। ধানের উৎপাদন মওসুমে বাজারমূল্যে কৃষকের খরচ উঠছে না। রাস্তাঘাট বিশ্রী চেহারা নিয়েছে। এলজিইডি গত ১৫ বছরে গ্রামাঞ্চলে যে শত শত কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছিল তার রক্ষণাবেক্ষণও বন্ধ। যেসব গ্রামে বিদ্যুৎসংযোগ গেছে এই গ্রীষ্মে সেখানে দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। নির্বাচনের আগে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও এমপিওভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সাড়ে তিন বছরে সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। গ্রামের সাধারণ মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভোট নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু চাকরি নিতে গিয়ে উল্টো টাকা গুনতে হচ্ছে। সাধারণ কোনো অরাজনৈতিক পরিবারের কেউ মেধার জোরে চাকরির পরীক্ষায় সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে সনদ না আনতে পারলে কাজে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরো বাড়ছে। বৃহত্তর নোয়াখালী এলাকার একজন নেতা জানান, সম্প্রতি তাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে একাধিক নেতাই পরিস্থিতির এ রকম চিত্র তুলে ধরেছেন। তারা বলেন, এলাকার মানুষ এখন অনেক সচেতন। বহু বিষয়ে গ্রামের মানুষ শহরের লোকেরও আগে খবর পেয়ে যান। তথ্যপ্রযুক্তি ও মোবাইল ফোনের কল্যাণে কথা ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। কারো মুখই আটকে রাখা যায় না। সত্যটা ঢেকেও রাখা যায় না। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে এমনসব কথা ছড়িয়ে পড়ে, যা বিব্রতকর। সব কথার জবাবও দেয়া যায় না। আমরা মুখ দেখাতে পারি না। তিনি বলেন, এত দিন গত সরকারের দুর্নীতির কথা বলেছি। মানুষ এখন উল্টো জিজ্ঞাসা করেÑ তারা তো অনেক আগেই বিদায় হয়েছে। আপনারা এত দিন কী করছেন? জবাব দিতে পারি না। সাতক্ষীরার এক নেতা জানান, আমরা এলাকায় সাধারণ মানুষের বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হই। ধান চালের দাম নেই। কৃষকের ঘরে ধান যতক্ষণ আছে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর টিভির পর্দায় মন্ত্রীদের বড় বড় কথা শুনে লোকজন মারমুখো হয়ে ওঠে। আমরা কী জবাব দেবো বুঝতে পারি না। পাবনা এলাকার এক নেতা জানান, এত দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছি। তারাই সব ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত এ কথা বহুবার বলেছি। এখন আর লোকজন এসব বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। সচিবালয়ে এক প্রতিমন্ত্রীর দফতরে আসা এসব জেলা নেতা প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। একজন বললেন, এসব কথা এখানে না বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন না কেন? বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার এক নেতা বললেন, আমরা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, আগামী দেড় বছরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ কথা মানুষকে বলব কিভাবে? সাড়ে তিন বছরে যা হয়নি দেড় বছরে তা কিভাবে হবে? যশোর এলাকার এক ইউপি চেয়ারম্যান বললেন, সরকারের এখনো দেড় বছর বাকি। এখনই ওসি, এসপিরা আমাদের কথা শুনছেন না। কোনো কথা বললে ‘দেখছি’ বলে রেখে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতা আলাপকালে জানান, নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরূপ মন্তব্যে আমরা লজ্জিত। মানুষ এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। তারা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ দেখতে চায়। সঙ্ঘাতের পথে তারা যেতে চায় না। কিন্তু এ ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছুকেই ম্লান করে দিচ্ছে। তারা বলছেন,একটি মন্দ দৃষ্টান্ত অন্য সব অর্জনকেও তুচ্ছ করে ফেলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাতারাতি উঠিয়ে দেয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আমরা এসব কথার জবাব দিতে পারছি না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সদস্য জানান, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমাদের কাছে জনগণের যে বিশাল প্রত্যাশা ছিল তা আমরা পূরণ করতে পারিনি। আমরা বিরোধী দলের দুর্নীতির কথা বলছি। নিজেদের কথা বলতে পারছি না। সাধারণ মানুষ ুব্ধ। তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছে না। তবে বলার সময় এলে তাদের ঠেকানোও যাবে না। কারণ সাফল্য- ব্যর্থতার বিচার করার ক্ষমতা জনগণের রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, সরকার যে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না এ কথা দিবালোকের মতো সত্য। তাদের ব্যর্থতা স্পষ্ট। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছিÑ সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতায়ই দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এত দিন যেসব কথা বলেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদন, অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার হয়েছে। সরকার এত দিন বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চালাচ্ছিল এসব রিপোর্টে তাও প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা যে সত্য বলেছিলাম তার প্রমাণ এখন বহির্বিশ্বও দিলো। তিনি বলেন, আমরা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সরকারপ্রধান নিজেই বলেছেন, দেশে এক-এগারোর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ জন্য তো আমরা দায়ী নই। সরকারের ব্যর্থতার পটভূমিতে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর জবাব সরকারকেই দিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সংলাপের বিরোধী নই। কিন্তু নেতাকর্মীদের জেলে রেখে সংলাপ হতে পারে না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০০৪ সালে র‌্যাব সৃষ্টি করা হয়েছে। তখন থেকেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলে আসছে। এখনো মাঝেমধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে পূর্ণ তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, কোনো দাগি আসামি ধরতে গিয়ে তারা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর গুলি ছোড়ে, তাহলে জীবন বাঁচাতে তারা পাল্টা গুলি করলে এটা হত্যাকাণ্ড না অন্য কিছু, সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সোর্স কী তা জানি না। তবে তাদের প্রতিবেদনের বিষয়টিও ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু জানান, সংসদের মধ্যে সংবিধানের আওতায় যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংসদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি তিনি এখন পর্যন্ত পড়েননি। সে কারণে এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সংলাপ করে কোনো সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত কয়েকজন এমপি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলে কী লাভ হবে? প্রধানমন্ত্রী তার পদে বহাল থাকলে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তিনি বলেন, অধিকার এমনিতেই কেউ দেয় না। বিএনপিকে অধিকার আদায় করে নিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধী দলের দাবি অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেন মহাজোটের শরিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতে পারে না। বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে সর্বদলীয় আলোচনার পপাতি তিনি। বিরোধী দলের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, বিকল্প নির্বাচনীব্যবস্থা তৈরি করুন, এর রূপরেখা উপস্থাপন করুন। সে বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ বা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এটা মানুষ বিশ্বাস করে না। সব মিলিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করতে হবে; অন্যথায় সঙ্ঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুর রহমান সেলিম বলেন, নির্বাচন অনেক দূরে। নির্বাচন নিয়ে সংলাপের আগে মানুষ বাঁচানোর সংলাপ করতে হবে। মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কৃষকের ধানের দাম নেই, মানুষের কাজ নেই, বিদ্যুতের চরম সঙ্কট, পানির জন্য হাহাকার, গুম, হত্যা, খুন, ইলিয়াস আলী ও সুরঞ্জিত ঘটনায় দুই ড্রাইভারের নিরুদ্দেশ, দেশী-বিদেশী চক্রান্তÑ এসব বিষয়ে আগে আলোচনা হওয়া দরকার। http://www.dailynayadiganta.com/details/48705

Monday 2 January 2012

আসক মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১১ : গুপ্তহত্যা ও কারা হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধিতে জনমনে আতঙ্ক










স্টাফ রিপোর্টার
দেশে গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আতঙ্কের বড় কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১১ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক রিপোর্টের পর্যালোচনায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিছু কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হলেও সার্বিক অবস্থা ছিল উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কিছু আচরণ জনমনে শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
রিপোর্টে রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও মামলা প্রত্যাহার করা এবং দেশে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, গুপ্তহত্যাসহ অন্যান্য ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে অসঙ্গত বক্তব্য দেয়ায় আসল ঘটনাটি ভিন্নদিকে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গতকাল আসক-এর বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য দেন আসক চেয়ারপার্সন হামিদা হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতানা কামাল। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির পরিচালক মো. নূর খান।
এদিকে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে হামিদা হোসেন বলেন, গুপ্তহত্যা দেশে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে তদন্ত দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না। আমাদের একজন স্টাফকে দু’মাস আগে সাদা পোশাকধারীরা ধরে নিয়ে যায়। এখনও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজ দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিএনপি গুম ও গুপ্তহত্যা করছে। তদন্তের আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন বক্তব্য এলে তদন্তের আর কিছু থাকে না।
আসক-এর সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১১ সালে অপরাধের নতুন প্রবণতা হিসেবে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুপ্তহত্যার’ ঘটনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঘটতে দেখা গেছে—যা অত্যন্ত ভয়াবহ। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘ক্রসফায়ারে’ ১০০ জন নিহত হয়েছেন। কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর কারা হেফাজতে ১১৬ কয়েদি ও হাজতির মৃত্যু হয়েছে। ভারতের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৩৯ বাংলাদেশী নিহত, আহত ৬৪ এবং ৩০ জন অপহৃত হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহ। ২০১১ সালে ৩০৫ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৩৪ জন। এ সময়ে বখাটেদের উত্পাতে ৩৩ নারী আত্মহত্যা এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে ২৩ জন খুন হয়েছেন। সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন, যার মধ্যে ১০৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। মোট ৬২ নারী এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড মওকুফ ও মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের তিন বছরে ৭ হাজার ১০০টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৭৮৫টিই ফৌজদারি এবং ৩১৫টি দুর্নীতির মামলা। আসক-এর পর্যালোচনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৬ জন মারা যান এবং ৬ হাজার ১৩৬ জন আহত হন। একইসঙ্গে পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে দুজন মারা যান এবং ১ হাজার ১০২ জন আহত হন। মোট ১১৭ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৭৪ জনই শিশু। আর এদের মধ্যে নির্যাতনে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, ৮ জন আত্মহত্যা করেছে এবং ৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
গুপ্তহত্যা : আসক-এর ৭ পাতার রিপোর্টের শুরুতে মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের দু’একটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করে বলা হয়—কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এসব উদ্যোগের ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। গুপ্তহত্যা ও নিখোঁজের ঘটনাকে অপরাধের নতুন প্রবণতা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি—যা অত্যন্ত ভয়াবহ। গুপ্তহত্যার শিকার কারও কারও হাত-পা বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা নির্যাতনের দৃশ্যমান চিহ্নসহ গলিত লাশ পাওয়া গেছে; আবার কেউ কেউ এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। বছরের বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশ পাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখোঁজ কিংবা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা এসব ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষত দেশের ‘এলিট ফোর্স’ র্যাবের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। এ ধরনের রহস্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রে প্রবণতা হলো প্রথমে ভিক্টিম ব্যক্তিরা নিখোঁজ হন এবং এর বেশ কিছুদিন পর নদী, খাল, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে হাত-পা বাঁধা ক্ষতবিক্ষত কারও কারও গলিত লাশ পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত এ কারণে যে, গুপ্তহত্যা বা নিখোঁজ হওয়ার মতো ঘটনা হঠাত্ করে বেড়ে যাওয়ার পর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ক্রমাগত অসঙ্গত বক্তব্য দিয়েছেন। এসব বক্তব্যে মূল সমস্যাকে আড়ালে রেখে ঘটনাটিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয়, বর্তমান সরকারের সময়েও এই ‘এলিট বাহিনীর’ বিরুদ্ধে অন্যান্য বছরের মতো এবছরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। র্যাবের পক্ষ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে তো কখনই স্বীকার করাই হয়নি বরং তাদের কোনো কোনো ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করলেও নিজেদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতে এ বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নসাপেক্ষ মন্তব্য ও পদক্ষেপ এসেছে। ২০১১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে/কর্তৃক মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনের। রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৬ জন মারা যান এবং ৬ হাজার ১৩৬ জন আহত হন। পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে দুজন মারা যান এবং ১১০২ জন আহত হন। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাসহ সন্ত্রাসীদের হাতে অন্যান্য হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্রই তুলে ধরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন শাসক দলের ক্যাডারদের ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা : গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল বেশি ছিল। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর চিকিত্সারত অবস্থায় বিএনপি সমর্থক আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ গত ২৬ আগস্ট মারা যান। হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে। আবার ১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুুল কাদেরকে পুলিশ আটক করার পর এতই নির্যাতন চালানো হয় যে, আদালতে তাকে হুইল চেয়ারের সাহায্যে হাজির হতে হয়েছে। অন্যদিকে গত ১৮ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে ৬ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা একটি সভ্য দেশের মানবিক মূল্যবোধকে চরমভাবে পদদলিত করেছে। নিহত ৬ তরুণের বেঁচে যাওয়া বন্ধু আল আমিনের বক্তব্যে পুলিশের উপস্থিতিতেই স্থানীয় জনগণ পিটিয়ে মারার কথা বলেছে। পুলিশের উপস্থিতিতে ৬ জন তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ জনগণের অনাস্থা এবং আস্থা রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতার ফসল বলে আমরা মনে করি। ওই ৬ তরুণের মৃত্যুর পর তাদেরই বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে ডাকাতি মামলা করে, যা পুলিশের ভূমিকাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাধারণ মানুষের এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের অসংবেদনশীল আচরণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করবে। এ বছর কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। এ বছর কারা হেফাজতে মারা যান ১১৬ জন। গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৩৪ জন।
সীমান্তে বিএসএফের হত্যা : বিএসএফ সীমান্তে একের পর এক হত্যা করলেও সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে জোরালো কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ফালানী নামের এক কিশোরীর নিহত হওয়ার ঘটনাসহ সবর্েশষ গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে ও ১৭ ডিসেম্বর সকালে দিনাজপুর, মেহেরপুর ও কুড়িগ্রামের সীমান্তে বিএসএফ চারজন বাংলাদেশী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে। এ বছর বিএসএফের হাতে ৩৯ জন নিহত হন, ৬৪ জন আহত হন এবং অপহরণের শিকার হন ৩০ জন।
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা ও ১৪৪ ধারা জারি : ২০১১ সালে বিরোধীদলের হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা বা হরতালের আগে গণগ্রেফতারের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি হরতালের আগে ও পরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এ বছর হরতালে মোবাইল কোর্ট ব্যবহারের বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত। হরতালের সমর্থনে বিরোধীদল মিছিল বের করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সময় বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন গ্রেফতার করে এবং মোবাইল কোর্টের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে তাত্ক্ষণিক শাস্তি দেন। হরতাল চলাকালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিনসহ পথচারীদের ওপর পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ ও অসংযত আচরণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তোলে। এছাড়া এ বছর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে ১৪৪ ধারা জারি করার প্রবণতা ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩৩ বার ১৪৪ ধারা জারি করার ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। মূলত বিরোধী শিবিরের ডাকা কর্মসূচির স্থলে সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠন পাল্টা কর্মসূচি ডাকায় প্রশাসন এ ধারা জারি করে, যা প্রকারান্তরে সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদের সমাবেশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নম্ন করে।
সাংবাদিক নির্যাতন : বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয়, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ২০১১ সালে সাংবাদিকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া ছাড়াও হয়রানি মামলা, প্রাণনাশের হুমকিসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-এর ২৭/৪ ধারা বাতিলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সংগঠিত সহিংস ঘটনায় ১৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাংচুরের মামলা করা হয়েছে। র্যাব দ্বারা বাংলাভিশন সাংবাদিক হাসানুল হককে মারধর, ট্রাফিক সিগন্যাল দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার কারণ জানতে চাওয়ায় দেশ টিভির যুগ্ম সম্পাদক গিয়াস আহমেদ পুলিশের নির্মম পিটুনির শিকার হন। এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে র্যাবের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে প্রথম আলো কর্মী মনজুর আহমেদকে র্যাবের গাড়িতে জোরপূর্বক তুলে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ বছর ৩০৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস ও মামলা প্রত্যাহার : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ তিন বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭ হাজার ১০০টি মামলা প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৭৮৫টি এবং দুর্নীতির ৩১৫টি। লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেতা ও লক্ষ্মীপুরের মেয়র আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লবের শাস্তি রাষ্ট্রপতি মাফ করেছেন। ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার জাতীয় কমিটি’ বিভিন্ন ধরনের মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দেখিয়ে তা বাতিলের জন্য সুপারিশ করে। খুনের মামলার আসামিসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আনীত মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে তার প্রায় সবগুলো হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মামলা।
নারী নির্যাতন : নারীর ওপর সহিংসতার ধরন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০১১ সালে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩ জন এবং এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের দ্বারা নিহত হয়েছেন ২৩ জন। সালিশ ও ফতোয়ার ঘটনায় মোট ৫৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি অপব্যবহারের কারণে ৪২ জন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এর মধ্যে ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। যৌতুকের কারণে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫০২ জন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৬২ জন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৮২ জন। ১১৭ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/01/02/125059