Monday 2 January 2012

আসক মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১১ : গুপ্তহত্যা ও কারা হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধিতে জনমনে আতঙ্ক










স্টাফ রিপোর্টার
দেশে গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আতঙ্কের বড় কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১১ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক রিপোর্টের পর্যালোচনায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিছু কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হলেও সার্বিক অবস্থা ছিল উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কিছু আচরণ জনমনে শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
রিপোর্টে রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও মামলা প্রত্যাহার করা এবং দেশে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, গুপ্তহত্যাসহ অন্যান্য ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে অসঙ্গত বক্তব্য দেয়ায় আসল ঘটনাটি ভিন্নদিকে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গতকাল আসক-এর বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য দেন আসক চেয়ারপার্সন হামিদা হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতানা কামাল। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির পরিচালক মো. নূর খান।
এদিকে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে হামিদা হোসেন বলেন, গুপ্তহত্যা দেশে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে তদন্ত দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না। আমাদের একজন স্টাফকে দু’মাস আগে সাদা পোশাকধারীরা ধরে নিয়ে যায়। এখনও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজ দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিএনপি গুম ও গুপ্তহত্যা করছে। তদন্তের আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন বক্তব্য এলে তদন্তের আর কিছু থাকে না।
আসক-এর সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১১ সালে অপরাধের নতুন প্রবণতা হিসেবে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুপ্তহত্যার’ ঘটনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঘটতে দেখা গেছে—যা অত্যন্ত ভয়াবহ। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘ক্রসফায়ারে’ ১০০ জন নিহত হয়েছেন। কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর কারা হেফাজতে ১১৬ কয়েদি ও হাজতির মৃত্যু হয়েছে। ভারতের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৩৯ বাংলাদেশী নিহত, আহত ৬৪ এবং ৩০ জন অপহৃত হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহ। ২০১১ সালে ৩০৫ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৩৪ জন। এ সময়ে বখাটেদের উত্পাতে ৩৩ নারী আত্মহত্যা এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে ২৩ জন খুন হয়েছেন। সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন, যার মধ্যে ১০৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। মোট ৬২ নারী এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড মওকুফ ও মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের তিন বছরে ৭ হাজার ১০০টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৭৮৫টিই ফৌজদারি এবং ৩১৫টি দুর্নীতির মামলা। আসক-এর পর্যালোচনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৬ জন মারা যান এবং ৬ হাজার ১৩৬ জন আহত হন। একইসঙ্গে পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে দুজন মারা যান এবং ১ হাজার ১০২ জন আহত হন। মোট ১১৭ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৭৪ জনই শিশু। আর এদের মধ্যে নির্যাতনে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, ৮ জন আত্মহত্যা করেছে এবং ৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
গুপ্তহত্যা : আসক-এর ৭ পাতার রিপোর্টের শুরুতে মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের দু’একটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করে বলা হয়—কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এসব উদ্যোগের ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। গুপ্তহত্যা ও নিখোঁজের ঘটনাকে অপরাধের নতুন প্রবণতা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি—যা অত্যন্ত ভয়াবহ। গুপ্তহত্যার শিকার কারও কারও হাত-পা বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা নির্যাতনের দৃশ্যমান চিহ্নসহ গলিত লাশ পাওয়া গেছে; আবার কেউ কেউ এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। বছরের বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশ পাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখোঁজ কিংবা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা এসব ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষত দেশের ‘এলিট ফোর্স’ র্যাবের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। এ ধরনের রহস্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রে প্রবণতা হলো প্রথমে ভিক্টিম ব্যক্তিরা নিখোঁজ হন এবং এর বেশ কিছুদিন পর নদী, খাল, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে হাত-পা বাঁধা ক্ষতবিক্ষত কারও কারও গলিত লাশ পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত এ কারণে যে, গুপ্তহত্যা বা নিখোঁজ হওয়ার মতো ঘটনা হঠাত্ করে বেড়ে যাওয়ার পর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ক্রমাগত অসঙ্গত বক্তব্য দিয়েছেন। এসব বক্তব্যে মূল সমস্যাকে আড়ালে রেখে ঘটনাটিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয়, বর্তমান সরকারের সময়েও এই ‘এলিট বাহিনীর’ বিরুদ্ধে অন্যান্য বছরের মতো এবছরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। র্যাবের পক্ষ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে তো কখনই স্বীকার করাই হয়নি বরং তাদের কোনো কোনো ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করলেও নিজেদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতে এ বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নসাপেক্ষ মন্তব্য ও পদক্ষেপ এসেছে। ২০১১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে/কর্তৃক মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনের। রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৬ জন মারা যান এবং ৬ হাজার ১৩৬ জন আহত হন। পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে দুজন মারা যান এবং ১১০২ জন আহত হন। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাসহ সন্ত্রাসীদের হাতে অন্যান্য হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্রই তুলে ধরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন শাসক দলের ক্যাডারদের ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা : গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল বেশি ছিল। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর চিকিত্সারত অবস্থায় বিএনপি সমর্থক আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ গত ২৬ আগস্ট মারা যান। হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে। আবার ১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুুল কাদেরকে পুলিশ আটক করার পর এতই নির্যাতন চালানো হয় যে, আদালতে তাকে হুইল চেয়ারের সাহায্যে হাজির হতে হয়েছে। অন্যদিকে গত ১৮ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে ৬ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা একটি সভ্য দেশের মানবিক মূল্যবোধকে চরমভাবে পদদলিত করেছে। নিহত ৬ তরুণের বেঁচে যাওয়া বন্ধু আল আমিনের বক্তব্যে পুলিশের উপস্থিতিতেই স্থানীয় জনগণ পিটিয়ে মারার কথা বলেছে। পুলিশের উপস্থিতিতে ৬ জন তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ জনগণের অনাস্থা এবং আস্থা রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতার ফসল বলে আমরা মনে করি। ওই ৬ তরুণের মৃত্যুর পর তাদেরই বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে ডাকাতি মামলা করে, যা পুলিশের ভূমিকাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাধারণ মানুষের এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের অসংবেদনশীল আচরণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করবে। এ বছর কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। এ বছর কারা হেফাজতে মারা যান ১১৬ জন। গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৩৪ জন।
সীমান্তে বিএসএফের হত্যা : বিএসএফ সীমান্তে একের পর এক হত্যা করলেও সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে জোরালো কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ফালানী নামের এক কিশোরীর নিহত হওয়ার ঘটনাসহ সবর্েশষ গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে ও ১৭ ডিসেম্বর সকালে দিনাজপুর, মেহেরপুর ও কুড়িগ্রামের সীমান্তে বিএসএফ চারজন বাংলাদেশী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে। এ বছর বিএসএফের হাতে ৩৯ জন নিহত হন, ৬৪ জন আহত হন এবং অপহরণের শিকার হন ৩০ জন।
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা ও ১৪৪ ধারা জারি : ২০১১ সালে বিরোধীদলের হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা বা হরতালের আগে গণগ্রেফতারের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি হরতালের আগে ও পরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এ বছর হরতালে মোবাইল কোর্ট ব্যবহারের বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত। হরতালের সমর্থনে বিরোধীদল মিছিল বের করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সময় বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন গ্রেফতার করে এবং মোবাইল কোর্টের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে তাত্ক্ষণিক শাস্তি দেন। হরতাল চলাকালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিনসহ পথচারীদের ওপর পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ ও অসংযত আচরণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তোলে। এছাড়া এ বছর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে ১৪৪ ধারা জারি করার প্রবণতা ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩৩ বার ১৪৪ ধারা জারি করার ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। মূলত বিরোধী শিবিরের ডাকা কর্মসূচির স্থলে সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠন পাল্টা কর্মসূচি ডাকায় প্রশাসন এ ধারা জারি করে, যা প্রকারান্তরে সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদের সমাবেশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নম্ন করে।
সাংবাদিক নির্যাতন : বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারদলীয়, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ২০১১ সালে সাংবাদিকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া ছাড়াও হয়রানি মামলা, প্রাণনাশের হুমকিসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-এর ২৭/৪ ধারা বাতিলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সংগঠিত সহিংস ঘটনায় ১৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাংচুরের মামলা করা হয়েছে। র্যাব দ্বারা বাংলাভিশন সাংবাদিক হাসানুল হককে মারধর, ট্রাফিক সিগন্যাল দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার কারণ জানতে চাওয়ায় দেশ টিভির যুগ্ম সম্পাদক গিয়াস আহমেদ পুলিশের নির্মম পিটুনির শিকার হন। এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে র্যাবের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে প্রথম আলো কর্মী মনজুর আহমেদকে র্যাবের গাড়িতে জোরপূর্বক তুলে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ বছর ৩০৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস ও মামলা প্রত্যাহার : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ তিন বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭ হাজার ১০০টি মামলা প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৭৮৫টি এবং দুর্নীতির ৩১৫টি। লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেতা ও লক্ষ্মীপুরের মেয়র আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লবের শাস্তি রাষ্ট্রপতি মাফ করেছেন। ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার জাতীয় কমিটি’ বিভিন্ন ধরনের মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দেখিয়ে তা বাতিলের জন্য সুপারিশ করে। খুনের মামলার আসামিসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আনীত মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে তার প্রায় সবগুলো হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মামলা।
নারী নির্যাতন : নারীর ওপর সহিংসতার ধরন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০১১ সালে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩ জন এবং এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের দ্বারা নিহত হয়েছেন ২৩ জন। সালিশ ও ফতোয়ার ঘটনায় মোট ৫৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি অপব্যবহারের কারণে ৪২ জন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এর মধ্যে ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। যৌতুকের কারণে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫০২ জন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৬২ জন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৮২ জন। ১১৭ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/01/02/125059

Sunday 1 January 2012

গুপ্তহত্যা : বছরের ট্র্যাজেডি

অলিউল্লাহ নোমান
বছরজুড়ে আলোচিত ছিল গুম, নদী-নালায় অজ্ঞাত লাশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়ার পর আর খোঁজ মেলে না। কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও অনেকে একেবারেই নিখোঁজ। লাশটি পর্যন্ত মেলে না। পরিবার পরিজন খোঁজাখুঁজির পর আশায় বুক বেঁধে থাকেন লাশটি অন্তত পাওয়া যাবে। কোথাও অজ্ঞাত লাশের সংবাদ পেলে সেখানে ছোটেন তারা। একটি অজ্ঞাত লাশের খোঁজ পেলে দশটি পরিবারও হাজির হন হাসপাতাল মর্গে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরে শুধু ঢাকা থেকে ৩০ জনের বেশি গুম হয়েছে। লাশ পাওয়া গেছে মাত্র ১০ জনের। বাকিরা সবাই নিখোঁজ রয়েছেন মাসের পর মাস ধরে। গত ২৮ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রাজধানীতে ৪ ব্যক্তি ২১ দিন ধরে নিখোঁজ। ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ উদ্ধার। ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদ বলা হয়, এবার পুলিশ সদস্য নিখোঁজ। ১৮ ডিসেম্বর আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, অপহরণের পর ১৬ পরিবারে হাহাকার। তাদের অনুসন্ধানী সংবাদটিতে আরও বলা হয়, এক বছরে রাজধানী ও আশপাশ এলাকা থেকে ২৭ জনকে অপহরণ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে। এর মধ্যে ১১ জনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকি ১৬ জন নিখোঁজ।
১৬ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোতে আরও একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় অপহরণ নিয়ে। সংবাদটিতে বলা হয়, ফরিদপুরে পাঁচজন নিখোঁজ। তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারীরা ধরে নেয়ার পর খোঁজ মিলছে না। ১৬ ডিসেম্বর অপহরণের পর লাশ উদ্ধারের আরও একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় জাতীয় দৈনিকগুলোতে। যশোর বিএনপির জনপ্রিয় নেতা নাজমুল ইসলাম ঢাকায় অপহরণের পর হাজিপুরে লাশ পাওয়া গেছে। ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, সাভারে অপহৃত হওয়ার পর এক মাস ধরে ব্যবসায়ীর হদিস নেই। একই সংবাদে বলা হয়, কিশোরগঞ্জে দুই বন্ধু নিখোঁজ। ১৫ ডিসেম্বর অপর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে বিদেশগামী যাত্রীকে বিদায় জানাতে ১১ নভেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ৭ জন। ওইদিন দুপুরে মালিবাগ এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়া হয় তাদের ২ জনকে। ঘটনার ১০ দিন পর আশুলিয়া এলাকা থেকে তাদের একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাকি ৪ জনের খবর মিলছে না। একইদিন আরও একটি সংবাদ ছিল, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাসুদ ২৯ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। ১৪ নভেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ধলেশ্বরীতে আরও ৩টি লাশ উদ্ধার। একইদিন অপর একটি পৃথক সংবাদে বলা হয়, বরগুনার দক্ষিণে সাগরে লাশ ভাসছে।
১০ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ঢাকার হাতিরপুল এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ৩ জনকে অপহরণ করা হয়। পরেরদিন পুলিশ মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ দু’টি ছিল হাতিরপুল থেকে অপহৃত দুই ছাত্রদল নেতার। ২৩ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানানো হয় পুলিশের সদস্য পরিচয়ে ঢাকার দয়াগঞ্জ থেকে ৩ তরুণকে ধরে নিয়ে হত্যা।
গুম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ হওয়ার পর আর খবর মিলছে না—এ ধরনের সংবাদ ছিল গত বছরজুড়ে। এতে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে ফিরতে পারবে কি-না বা নিজের লাশটি আত্মীয়স্বজন পাবে কি-না, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ উত্কণ্ঠা বিরাজ করছে। গেল বছরটিতে গুম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ হওয়া বা লাশ এখানে-সেখানে পড়ে থাকার ঘটনায় উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে যায় মানুষের মনে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ভাষায়, এগুলো হচ্ছে নতুনরূপে ক্রসফায়ার। তিনি বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে দাবি করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না—এমন অভিযোগ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনেও আসছে। ইউনিফরম বা নির্ধারিত পোশাক ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে গ্রেফতার অভিযানে না যায়, সেজন্য তিনি সরকারের প্রতিও দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর গুম হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর থেকে দুই বছরেও কোনো খোঁজ মিলছে না। তার পরিবার এখনও জানে না চৌধুরী আলমের পরিণতি কী হয়েছে। এমন আরও অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে।