Sunday 1 January 2012

গুপ্তহত্যা : বছরের ট্র্যাজেডি

অলিউল্লাহ নোমান
বছরজুড়ে আলোচিত ছিল গুম, নদী-নালায় অজ্ঞাত লাশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়ার পর আর খোঁজ মেলে না। কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও অনেকে একেবারেই নিখোঁজ। লাশটি পর্যন্ত মেলে না। পরিবার পরিজন খোঁজাখুঁজির পর আশায় বুক বেঁধে থাকেন লাশটি অন্তত পাওয়া যাবে। কোথাও অজ্ঞাত লাশের সংবাদ পেলে সেখানে ছোটেন তারা। একটি অজ্ঞাত লাশের খোঁজ পেলে দশটি পরিবারও হাজির হন হাসপাতাল মর্গে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরে শুধু ঢাকা থেকে ৩০ জনের বেশি গুম হয়েছে। লাশ পাওয়া গেছে মাত্র ১০ জনের। বাকিরা সবাই নিখোঁজ রয়েছেন মাসের পর মাস ধরে। গত ২৮ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রাজধানীতে ৪ ব্যক্তি ২১ দিন ধরে নিখোঁজ। ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ উদ্ধার। ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদ বলা হয়, এবার পুলিশ সদস্য নিখোঁজ। ১৮ ডিসেম্বর আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, অপহরণের পর ১৬ পরিবারে হাহাকার। তাদের অনুসন্ধানী সংবাদটিতে আরও বলা হয়, এক বছরে রাজধানী ও আশপাশ এলাকা থেকে ২৭ জনকে অপহরণ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে। এর মধ্যে ১১ জনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকি ১৬ জন নিখোঁজ।
১৬ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোতে আরও একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় অপহরণ নিয়ে। সংবাদটিতে বলা হয়, ফরিদপুরে পাঁচজন নিখোঁজ। তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারীরা ধরে নেয়ার পর খোঁজ মিলছে না। ১৬ ডিসেম্বর অপহরণের পর লাশ উদ্ধারের আরও একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় জাতীয় দৈনিকগুলোতে। যশোর বিএনপির জনপ্রিয় নেতা নাজমুল ইসলাম ঢাকায় অপহরণের পর হাজিপুরে লাশ পাওয়া গেছে। ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, সাভারে অপহৃত হওয়ার পর এক মাস ধরে ব্যবসায়ীর হদিস নেই। একই সংবাদে বলা হয়, কিশোরগঞ্জে দুই বন্ধু নিখোঁজ। ১৫ ডিসেম্বর অপর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে বিদেশগামী যাত্রীকে বিদায় জানাতে ১১ নভেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ৭ জন। ওইদিন দুপুরে মালিবাগ এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়া হয় তাদের ২ জনকে। ঘটনার ১০ দিন পর আশুলিয়া এলাকা থেকে তাদের একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাকি ৪ জনের খবর মিলছে না। একইদিন আরও একটি সংবাদ ছিল, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাসুদ ২৯ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। ১৪ নভেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ধলেশ্বরীতে আরও ৩টি লাশ উদ্ধার। একইদিন অপর একটি পৃথক সংবাদে বলা হয়, বরগুনার দক্ষিণে সাগরে লাশ ভাসছে।
১০ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ঢাকার হাতিরপুল এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ৩ জনকে অপহরণ করা হয়। পরেরদিন পুলিশ মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ দু’টি ছিল হাতিরপুল থেকে অপহৃত দুই ছাত্রদল নেতার। ২৩ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানানো হয় পুলিশের সদস্য পরিচয়ে ঢাকার দয়াগঞ্জ থেকে ৩ তরুণকে ধরে নিয়ে হত্যা।
গুম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ হওয়ার পর আর খবর মিলছে না—এ ধরনের সংবাদ ছিল গত বছরজুড়ে। এতে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে ফিরতে পারবে কি-না বা নিজের লাশটি আত্মীয়স্বজন পাবে কি-না, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ উত্কণ্ঠা বিরাজ করছে। গেল বছরটিতে গুম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ হওয়া বা লাশ এখানে-সেখানে পড়ে থাকার ঘটনায় উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে যায় মানুষের মনে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ভাষায়, এগুলো হচ্ছে নতুনরূপে ক্রসফায়ার। তিনি বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে দাবি করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না—এমন অভিযোগ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনেও আসছে। ইউনিফরম বা নির্ধারিত পোশাক ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে গ্রেফতার অভিযানে না যায়, সেজন্য তিনি সরকারের প্রতিও দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর গুম হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর থেকে দুই বছরেও কোনো খোঁজ মিলছে না। তার পরিবার এখনও জানে না চৌধুরী আলমের পরিণতি কী হয়েছে। এমন আরও অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে।

No comments:

Post a Comment