Saturday 8 January 2011

নগরজুড়ে তীব্র গ্যাস সঙ্কট



কাজী জেবেল

গ্যাস সঙ্কটে জ্বলছে না রান্নার চুলা। ঢাকা, সাভার, টঙ্গী, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ অনেক এলাকায় বেশিরভাগ সময় পাইপে গ্যাস না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু এলাকায় গ্যাস থাকলেও লাইনে চাপ কম থাকায় মিটমিটিয়ে জ্বলছে চুলা। ফলে ঠিকমতো রান্না করতে না পারায় রাজধানী ও আশপাশ এলাকার মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এছাড়া পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় শিল্প-কারখানা ও সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে উত্পাদন। অনেক শিল্প-কারখানায় দিনে কাজ কমিয়ে রাতে কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রাতে গ্যাসের চাপ কিছুটা বাড়ার কারণে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ করা ও সিএনজি স্টেশনে রেশনিং পদ্ধতি চালু করার পরও গ্যাসের ঘাটতি কমাতে না পারায় ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন কমছে, তেমনি দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া গত ৪ জানুয়ারি এক সেমিনারে বিদ্যুত্-গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন।
এদিকে আশার কোন বাণী শোনাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তিতাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদিন ২৫০ থেকে ২৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের বিপরীতে উত্পাদন হচ্ছে ১৯৬ থেকে ১৯৭ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ৫৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস। আগামী দুই বছরেও এ সমস্যার সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্যাসের দাবিতে তিতাসের বিভিন্ন অভিযোগ কেন্দ্রে প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে। এদিকে গ্যাস সঙ্কটকে পুঁজি করে তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বোতলজাত এলপিজি গ্যাসেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এদিকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ জনগণ। গতকাল মিরপুর, মুগদাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্যাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। যে কোনো সময় তা জনবিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
মিরপুর এলাকার কাজীপাড়ার বাসিন্দা গৃহিণী জান্নাতুল ফেরদৌস গ্যাস সঙ্কটে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, শীত আসার পর থেকে ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এরপর গ্যাস এলেও রাত ১০টা পর্যন্ত লাইনে চাপ থাকে না। এতে মিটিমিটি করে চুলা জ্বলে, যা দিয়ে রান্না করা যায় না। তবে ১০টার পর গ্যাসের চাপ তুলনামূলকভাবে বাড়ে। মগবাজারের গ্রিনওয়ে এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী তাবিয়া সুলতানা বলেন, গ্যাসের অভাবে দিনে রান্না করা যাচ্ছে না। রাত জেগে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রান্না করতে হচ্ছে। মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার এলাকায় এক মাসের বেশি সময় ধরে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। সাভারের ধলপুর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন, রিয়ার উদ্দিনসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, গত এক থেকে দেড় মাস ধরে দিনে গ্যাস থাকে না। ফলে ওই এলাকার বাসিন্দারা গভীর রাত পর্যন্ত সারাদিনের খাবার রান্না করে রাখেন। একই অভিযোগ করেছেন পুরান ঢাকা, সূত্রাপুর, শান্তিনগর, বাসাবো, উত্তরাসহ বেশিরভাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা। নারায়ণগঞ্জ ও সাভার শিল্প এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে উত্পাদন কমে গেছে। দিনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে গ্যাসসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন) খালিদ হাসান গ্যাস সঙ্কটের কথা স্বীকার করে গতকাল আমার দেশকে বলেন, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন অর্থাত্ ২৫০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ১ হাজার ৯৬০-৯৭০ মিলিয়ন অর্থাত্ ১৯৬ থেকে ১৯৭ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি থাকছে ৫৩০ মিলিয়ন বা ৫৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস। তিনি বলেন, শীতের মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নাগরিকরা গ্যাস সঙ্কটে ভুগছেন। এ সময় তাপমাত্রা কম থাকায় পানিসহ শিল্প-কারখানার মেশিনারিজ সামগ্রী গরম করতে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। তাই সঙ্কট বেড়ে যায়। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আজিজ খান আমার দেশকে বলেন, চলতি শীত মৌসুমে গ্যাস সঙ্কটের সমাধান হবে বলে মনে হয় না। এজন্য ক্ষুদ্র কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য কম্প্রেসর স্থাপন যতদিন পর্যন্ত করা না যাবে ততদিন অবস্থার উন্নতি হবে না। ২০১২ সালের শেষ নাগাদ অথবা ২০১৩ সালের প্রথমদিকে কম্প্রেসর স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এ সময় পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। দৈনিক প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় তিতাসের আবাসিক সংযোগ রয়েছে ২০ লাখের কাছাকাছি। এছাড়া প্রায় ১৫ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তিতাসের গ্যাস ব্যবহার করে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এসব ব্যবহারকারী বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় উত্পাদনে ধস নামছে। এ অবস্থায় রফদানীমুখী কারখানাগুলো নির্দিষ্ট সময়ে অর্ডার সরবরাহ করা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বিকল্প হিসেবে তারা দিনের চেয়ে রাতে কারখানা চালু রাখছে। এতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। এছাড়া তিতাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজি গ্যাস ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই। কিন্তু গত এক মাসে প্রতি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাসের দাম বেড়েছে ২০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত। কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট দামের চেয়ে ১ হাজার টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে। গতকাল ঢাকার দক্ষিণ মুগদা ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। জুমার নামাজের পর স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়ে তারা এলাকায় অবিলম্বে গ্যাস সঙ্কট সমাধানের দাবি জানান। ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা আহমেদুল কবির জাকির জানান, গ্যাসের অভাবে এলাকার প্রায় ৯০টি বাড়ির ৬ হাজারের বেশি বাসিন্দা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রতি মাসে এসব বাড়ি থেকে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা গ্যাস বিল দেয়া হচ্ছে। অথচ তারা দিনে এমনকি গভীর রাতেও গ্যাস সমস্যায় ভোগেন। গৃহিণীরা রাত জেগে ভোর রাতে রান্না করেন। এ সমস্যার প্রধান কারণ ১৯৮০ সালে স্থাপন করা একইঞ্চি পাইপলাইন। ওই সময় এলাকায় বাড়িঘর ছিল ১০-১২টি। এখন জনসংখ্যা ও বাড়ি বেড়েছে। কিন্তু লাইনের কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৯ সালে তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক বিপণন দক্ষিণ বরাবর আবেদন করেন এলাকাবাসী। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সমস্যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গতকাল আয়োজিত সমাবেশে স্থানীয় বাসিন্দারা অবিলম্বে গ্যাস সঙ্কট সমাধানের দাবি জানান। দাবি আদায়ের জন্য তারা সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন আন্দোলনের ঘোষণা দেন। মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনের সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকায়ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়

No comments:

Post a Comment