Friday 7 January 2011

শাসকদলের মন্ত্রী-এমপিদের কর্মকাণ্ডে বিব্রত ইসি : তিনজনকে সতর্ক করে চিঠি : মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এলাকায় গিয়ে অপরাধ করেছেন : ছহুল



কাজী জেবেল

পৌরসভা নির্বাচনী এলাকায় শাসকদলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ ও সংসদ সদস্যদের বিতর্কিত এবং প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে বিব্রত নির্বাচন কমিশন। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশন ড. এটিএম শামসুল হুদা এ নিয়ে ময়মনসিংহে জনসম্মুখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তফসিল ঘোষিত পৌর এলাকায় এসব ব্যক্তিকে না যেতে কমিশন থেকে বারবার অনুরোধ জানানো হয়। এর পরও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জেতানোর জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ভোটারদের প্রভাবিত করতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় সফর করছেন। তারা উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধন ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। পাশাপাশি সরকারি দলের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকারি দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলেও বিস্তর অভিযোগ পেয়েছে কমিশন। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অনেকটা অসহায় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের জনবল স্বল্পতা ও প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকায় ক্ষমতাধর এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না কমিশন। তবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা চেয়ে এ পর্যন্ত তিনজনকে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন আমার দেশকে বলেন, ‘কমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করে যেসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তি নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছেন, আইন অনুযায়ী তারা অপরাধ করেছেন। তাদের মতো উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের আইন অমান্য করে এভাবে নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া উচিত হয়নি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আমরা দু’তিনজনকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছি। এর পরও তারা একই ধরনের কাজ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। তবে আমরা হার্ডলাইনে যেতে চাই না। তিনি আরও বলেন, আইনে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এ সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো সংসদ সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
জানা গেছে, আইনে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১০-এর ৬ নম্বর ধারার ১৫-এর(ক) ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ এবং সরকারের কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা তাদের সমপদমর্যাদার সরকারি সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি, নির্বাচনপূর্ব সময়ে নির্বাচনী প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তফসিল ঘোষণার পর থেকে বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা ভ্রমণ করছেন। এ নিয়ে কমিশনে অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত শনিবার ফরিদপুর যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সুবল সাহার পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে দলীয় কর্মী ও ভোটারদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। পৌর এলাকা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেন, সুবল সাহা নির্বাচিত হলে ফরিদপুরে ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’র মতো একটি অত্যাধুনিক শিশুপার্ক নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, সুবল সাহা নির্বাচিত হলে আমার সাহায্য পাওয়া যাবে। ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ের কাছে পৌরসভার যে চার একর জমি আছে, সেখানে একটি অত্যাধুনিক শিশুপার্ক নির্মাণ করে দেয়া হবে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর এলাকায় অবস্থান করেন। ওই পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শফিকুল ইসলাম হবিকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় লোকদের মধ্যে ২৬০টি শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। কলতাপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার উদ্যোগে আয়োজিত ইসলামী সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া শালিয়হর বধ্যভূমির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন, বিনামূল্যে চক্ষুচিকিত্সার ৭ দিনব্যাপী কার্যক্রমের উদ্বোধন, কৃতী ছাত্র সংবর্ধনা, গৌরিপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কাউট সমাবেশে যোগদান এবং স্থানীয় আওয়ামী, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাজাহান মিয়া নির্বাচন প্রভাবিত করতে গত ৮ ডিসেম্বর যান বলে কমিশনে অভিযোগ এসেছে। এতে বলা হয়েছে, পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর ছেলে তারিকুজ্জামান মনির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি ১১ দিনের সফরে পটুয়াখালী যান। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে তাকে নোটিশ করা হলে তিনি একদিন অবস্থান করে ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরেন। অবশ্য পরে মনি তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। আওয়ামী লীগদলীয় হুইপ শেখ আবদুল ওহাব নির্বাচনী প্রচারণা চালানো, ডাকবাংলো ব্যবহার এবং দলীয় প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনী আচরণবিধিমালা ভঙ্গ করেছেন বলে কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান।
পৌর এলাকায় সংসদ সদস্যদের যেতে কোনো আইনি বাধা নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশকিছু পৌর এলাকায় মহাজোটের সংসদ সদস্যরা নির্বাচন, নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কমিশনে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন তদন্তের জন্য জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কালিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে কবিরুল হকের ভাই ইকরামুল হক টুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ওই এলাকায় কবিরুল হক ও তার বাহিনীর সদস্যরা বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। তারা নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেল মহড়া ও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে। পুলিশ চাকরি হারানোর ভয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হবে বলে জানা গেছে। ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও ইব্রাহিম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন লালমোহন পৌরসভায় উপস্থিত থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমদাদুল হক তুহিনের পক্ষে ভোট চাইছেন। ওই এলাকায় তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, পথসভার নামে জনসভা, গণসংযোগের নামে মিছিল-মিটিংসহ একাধিক আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ঢালাওভাবে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না। কিন্তু সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে কোনো বাধানিষেধ না থাকায় তারা দলীয় প্রার্থীদের জেতাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ কারণে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটছে এবং তাতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে

No comments:

Post a Comment