Tuesday 26 April 2011

টিএইচ খান ও রফিক-উল হক : ফতোয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার আদালতের নেই

স্টাফ রিপোর্টার

ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরির মতামতে প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান ও ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ফতোয়া হচ্ছে পবিত্র কোরআন, হাদিস ও ইসলামী শরিয়াভিত্তিক অভিমত বা উপদেশ। কাজেই ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করে রায় দেয়া তো দূরের কথা, এ নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলারও এখতিয়ার কোনো আদালতের নেই। দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের আলোকেও ফতোয়া বৈধ বলে মত দেন তারা। ফতোয়া দেয়া ও নেয়া সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে গতকাল তারা এ অভিমত পেশ করেন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বিচারপতি গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ কোনো অভিযোগ বা মামলা ছাড়াই স্বপ্রণোদিত হয়ে ফতোয়া নিষিদ্ধ করে রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে দুটি আপিল করা হয়। বর্তমানে আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে এ আপিল দুটির শুনানি একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফতোয়ার বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য আদালত সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খান এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ ১০ বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : গতকাল ফতোয়া নিয়ে আপিলের শুনানি শুরু হলে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংবিধান, বিভিন্ন আইন, বিভিন্ন মামলার নজির ও বিভিন্ন দেশের রেফারেন্স তুলে ধরে আদালতে বলেন, ফতোয়া হচ্ছে সংবিধানস্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার। ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা আদৌ সঠিক নয়। এ ধরনের রায় দেয়ার এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। তিনি বলেন, ফতোয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত অভিমত। এ অভিমতের ভিত্তিতেই আমাদের সমাজ ও পারিবারিক শৃঙ্খলা টিকে রয়েছে। অভিমত বা মতামত দেয়ার অধিকার সবার রয়েছে। এটা সাংবিধানিক অধিকারও। তবে কোনো নির্বাহী আদেশ নয়, কেউ ইচ্ছে করলে এটা গ্রহণ করতে পারে আবার নাও করতে পারে। তবে আমাদের দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ফতোয়াকে বাধ্যবাধকতা বলে মনে করে। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ফতোয়ার অপব্যবহার হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশে প্রায় সব আইনেরই যেমন ব্যবহার রয়েছে, তেমনিভাবে এর অপব্যবহার আছে। মূল কথা হলো অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এটা করতে গিয়ে যে একেবারে আইনটিই নিষিদ্ধ করে দিতে হবে, এমনটি নয়। তিনি বলেন, কেউ যদি ফতোয়ার নামে কাউকে শাস্তি দেন, তবে সেটি অপরাধ। এ অপরাধের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে আদালত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
বিচারপতি টিএইচ খান : ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অধিকার কোনো আদালতের নেই বলে উল্লেখ করে সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খান বলেন, যারা ফতোয়া নিষিদ্ধ করে অতি-উত্সাহী রায় দিয়েছেন তারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে এর পরিণাম কত ভয়ঙ্কর হবে? তারা হয়তো না বুঝেই এটা করেছেন। কিন্তু ফতোয়া নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার তাদের ছিল না। তারা এখতিয়ারবহির্ভূত কাজটি করে সমাজকে একটি চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ীই ফতোয়া বৈধ এবং ফতোয়া দেয়া ও গ্রহণ করা সাংবিধানিক অধিকার। ফতোয়ার নামে যদি কোথাও কোনো অপরাধ হয়, সেটা প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য আমাদের দেশে প্রচলিত আইন রয়েছে। তবে এখন কেউ কেউ গ্রাম্য সালিশকেও ফতোয়া হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে লেগেছেন। এটাও ঠিক নয়। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে আমাদের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। যৌতুকপ্রথা বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে ইভটিজিংসহ নারী নির্যাতনও বেড়ে যাবে। সামাজিক শৃঙ্খলার জন্যই ফতোয়ার বিষয়টিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ, ৪১ অনুচ্ছেদ থাকলে ধর্মীয় স্বাধীনতাও থাকবে। আর ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলে মুসলমানদের ফতোয়া দেয়া ও নেয়ার অধিকারও থাকবে। ফতোয়ার নামে যদি কেউ এর অপব্যবহার করে, তার জন্য ইসলামের এই অবিচ্ছেদ্য বিধান অবৈধ ঘোষণা করার কোনো আইনি বা যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
বিচারপতি গোলাম রব্বানী কোনো অভিযোগ কিংবা মামলা ছাড়াই নিজ উদ্যোগে ফতোয়াকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ২০০১ সালে রায় দেন। অবসর নেয়ার পর নাস্তিক ও ভারতপন্থী হিসেবে বিচারপতি গোলাম রব্বানী তথাকথিত ঘাদানি কমিটিসহ ইসলামবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের উপদেষ্টার পদ নেন এবং তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দিয়ে ফতোয়াসহ ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া অব্যাহত রাখেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে ফতোয়া নিষিদ্ধ করে তার দেয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০১ সালেই মুফতি মো. তৈয়ব ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল বিভাগে পৃথকভাবে দুটি আপিল করেন। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। বর্তমানে ওই আপিলের শুনানি চলছে। আদালত দশজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করে মতামত নেন। এ ছাড়াও দেশের খ্যাতিমান পাঁচ আলেমকে তাদের মতামত দেয়ার জন্য বলেছেন। গত ২০ মার্চ লিখিতভাবে তারা তাদের মতামত পেশ করেন। পাঁচ আলেমসহ অ্যামিকাস কিউরিদের প্রায় সবাই ফতোয়ার বিধান বহাল রাখা এবং হাইকোর্টের রায় বাতিলের পক্ষে মত দেন।

No comments:

Post a Comment