Tuesday 12 April 2011

ইসলামী সংগঠনের বিক্ষোভে উত্তাল রাজধানী : কোরআনবিরোধী নারীনীতি প্রতিহত করার ঘোষণা













স্টাফ রিপোর্টার

কোরআনবিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলসহ বর্তমান আওয়ামী সরকারের ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল বিক্ষোভে উত্তাল ছিল রাজধানী ঢাকা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী প্রায় সব ধর্মীয় সংগঠন ও মুসল্লির উদ্যোগে দিনব্যাপী চলে বিক্ষোভ। তবে বাদ জুমা বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে মুক্তাঙ্গন এলাকায় জড়ো হলে পল্টন ও আশপাশের এলাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। একই সময় বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে স্থবির হয়ে পড়ে এ এলাকার স্বাভাবিক কার্যক্রম। পল্টন থেকে জিরো পয়েন্ট, প্রেসক্লাব, নাইটিংগেল মোড়, দৈনিক বাংলাসহ বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা। আগে থেকেই পল্টন এলাকায় পানিকামান, রায়ট কার ও প্রিজনভ্যান নিয়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিলেও তারা মিছিলকারীদের বাধা দেয়নি।
পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বক্তারা আওয়ামী সরকারের কোরআন ও ইসলামবিরোধী সব কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, এদেশ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। এখানে কোরআন ও ইসলামবিরোধী কোনো আইন করতে দেয়া হবে না। জীবন দিয়ে হলেও এসব আইন প্রতিহত করা হবে। তারা বলেন, অবিলম্বে কোরআনবিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ফতোয়াবিরোধী রায়, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল এবং ইমামদের সামনে নৃত্যানুষ্ঠান করার অপরাধে ইফা ডিজিকে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। তারা ৪ এপ্রিল ঘোষিত হরতাল
সফলের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই হরতালে সরকার বাধা দিলে মিসরের তাহরির স্কয়ারের মতো ঢাকা অবরোধ করা হবে। এদিকে রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদ : গতকাল বাদ জুমা পল্টন এলাকায় সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদ। মুক্তাঙ্গনে মিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ড. খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার কোরআনবিরোধী যেসব আইন
করতে যাচ্ছে, এদেশের মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও তা প্রতিহত করবে। উলামারা শহীদ হতে জানেন। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রয়োজনে এদেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তিনি অবিলম্বে কোরআনবিরোধী নারী উন্নয়ন নীতি খসড়া ও নাস্তিক্য শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি করেন। অন্যথায় সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন তিনি। সমাবেশ থেকে আগামী মঙ্গলবার প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং ১৮ মার্চ সারাদেশে সব মসজিদ থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানির সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন ইসলামিক পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল মোবিন, মুসলিম লীগ মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, ন্যাপ ভাসানী সভাপতি শেখ আনোয়ারুল হক, শর্ষিনার পীর শাহ আরিফ বিল্লাহ সিদ্দিকী, মাওলানা আহমেদ আলী কাসেমি, মমতাজ চৌধুরী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিশাল একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে পল্টন, প্রেস ক্লাব, কদম ফোয়ারা মোড়, কাকরাইল হয়ে মালিবাগ মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এ মিছিলে আরও অংশ নেয় আহকামে শরিয়াহ হেফাজত কমিটি, মাদ্রাসা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ, ইসলাহুল মুসলিমিন বাংলাদেশ, জাতীয় ফতোয়া বোর্ড, আইম্মাহ পরিষদ প্রমুখ সংগঠন। এদিকে দেশের সব বিভাগ এবং বড় জেলাতেও উলামা পরিষদের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : কোরআনবিরোধী নারীনীতি বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে মুক্তাঙ্গনে বিরাট সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বাদ জুমা সমাবেশ শুরু হয়ে বিকাল পর্যন্ত চলে। এতে ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে লোকজন যোগ দেয়। দলের ঢাকা মহানগর সভাপতি অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিনের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের নায়েবে আমির মাওলানা ফয়জুল করিম বলেন, সম্পদ বণ্টনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার বাস্তবায়ন হলে দেশের ঘরে ঘরে আগুন জ্বলে উঠবে। নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন— ঘরে কী আপনাদের স্বামীরা আপনাদের অধিকার দেয় না। যারা চিল্লাচ্ছেন, তাদের পরিবারে শান্তি নেই। তাদের স্বামীদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
সমাবেশে ঢাকা মহানগর আমির অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন বলেন, সরকার নারীনীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে সংসদ, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করা হবে।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি : কোরআনবিরোধী নারী নীতিমালার প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীসহ সব জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি। কেন্দ্রীয়ভাবে বাদ জুমা মুক্তাঙ্গনে মিছিলপূর্ব সমাবেশে সভাপতির ভাষণে কমিটির আমির ও ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, আগামী ৪ এপ্রিলের হরতাল হলো কোরআন রক্ষার হরতাল। হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের হরতাল। এ হরতাল সফলে মাঠে নামা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে ফতোয়ার ব্যাপারে মতামত প্রদানের জন্য আলেম নির্বাচন করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামী ফাউন্ডেশনের কবরপূজারি ডিজি শামিম মুহাম্মদ আফজালকে। আমরা তার এ নির্বাচনকে মানি না। কারণ সে কোরআনের দুশমন, ইসলামের দুশমন, রাসুলের দুশমন। সে ইমামদের সঙ্গে নর্তকী নাচিয়েছে। সমাবেশে অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতি মুহাম্মদ তৈয়্যেব, অধ্যাপক মাওলানা আবদুল করিম, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আবুল কাশেম, মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াছেল প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিশাল মিছিল মুক্তাঙ্গন থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কওমী মাদ্রাসা বোর্ড : বিভিন্ন দাবিতে সকালে মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা বোর্ড (বেফাক)। মিছিলপূর্ব সমাবেশে বক্তারা বলেন, সম্পদে নারী-পুরুষ সমান সুযোগের নীতি করেও জনগণকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। গণমাধ্যমে ছলনাময় মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর গলাবাজি করছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন। নারী নীতিমালায় ১৯টি সমস্যা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা। সমাবেশে বিতর্কিত জাতীয় শিক্ষানীতির বিষয়ে বেফাকের ১২ দফা ও ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
বেফাক সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলীর সভাপতিত্বে মিডিয়া শাখার সমন্বয়ক হুমায়ুন আইয়ুবের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি মুফতি শহিদুল ইসলাম, মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার, সহকারী মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, আল্লামা আবদুল মালেক হালিম, মাওলানা নিজাম উদ্দিন, খেলাফত আন্দোলনের জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী, মুফতি মো. তৈয়ব, মুফতি বশির উল্লাহসহ প্রায় অর্ধশত মাদ্রাসা প্রতিনিধি।
খেলাফত মজলিস : বিক্ষোভ মিছিলপূর্ব সমাবেশে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, কোরআন ও ইসলামের শত্রু বর্তমান সরকারের পতনই এখন একমাত্র বিকল্প। ক্ষমতায় এসে তারা একের পর এক কোরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে যাচ্ছে। এ সরকারের হাতে দেশ, জনগণ ও ইসলাম নিরাপদ নয়।
দলের ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা নোমান মাজহারীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মাওলানা শফিক উদ্দিন, শেখ গোলাম আসগর, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জলিল প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বিজয়নগর, পল্টন, প্রেস ক্লাব এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
মহিলা জামায়াত : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি খোন্দকার আয়শা সিদ্দিকা বলেছেন, ইসলাম নারীকে যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে—তা আমাদেরকে যথাযথভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। কোরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার আইন যথেষ্ট বাস্তব ও নারীর জন্য সম্মানজনক। তিনি গতকাল সংগঠনের ধানমন্ডিতে মহানগরী কার্যালয়ে আয়োজিত থানা সেক্রেটারি সম্মেলনে সভানেত্রীর বক্তব্যে এ কথা বলেন।
খেলাফত মজলিস : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী বলেন, ফতোয়া আছে, থাকবে। এর বিরুদ্ধে যারাই কথা বলবে, তাদের ব্যাপারে এদেশের ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামপ্রিয় তাওহিদি জনতা সিদ্ধান্ত নেবে। গতকাল বাদ জুমা মুক্তাঙ্গন থেকে বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মজলিসের নগর সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুস সামাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল, মাওলানা এনামুল হক মুসা, এম ছালেহ আহমদ, হাফেজ শামসুল আলম, নোমান উদ্দিন প্রমুখ।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নেতারা বলেন, ইসলামবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল ধর্মহীন আওয়ামী সরকার এদেশ থেকে কোরআন-হাদিস ও ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস নির্মূলের যে নীল নকশা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে—তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব।
মাদ্রাসা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ : সরকারের কোরআনবিরোধী নারীনীতি অনুমোদন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ মাদ্রাসা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট থেকে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি পল্টন-প্রেস ক্লাব-কাকরাইল হয়ে মালিবাগ মোড়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়

No comments:

Post a Comment