Tuesday 26 April 2011

যশোরে মাদ্রাসা ছাত্রদের মিছিলে গুলি : ধাওয়া করে এক হাফেজকে হত্যা












যশোর অফিস

বিতর্কিত নারীনীতির প্রতিবাদে যশোরে মাদ্রাসা ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করেছে। গুলিতে এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছে। তার নাম হুসাইন আহমদ। সে কুরআনের হাফেজ। লাঠিচার্জে মাদ্রাসা ছাত্রদের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুলিশ ধাওয়া করে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। এসময় লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণে আহত হয়েছে আরও ৩০ জন মাদ্রাসা ছাত্র। গুরুতর আহত একজন নিখোঁজ রয়েছে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে মুজিব সড়কে জিলা স্কুলের সামনে বিনা উস্কানিতে পুলিশ মিছিলে হামলা চালায়। মোট ৭৭ রাউন্ড গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেছে পুলিশ।
যশোরে গুলিবর্ষণ ও নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। হত্যার প্রতিবাদ ও হরতালের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। গুলিতে মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে যশোরের জেলা প্রশাসক ১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যার বিচার দাবি করেছে ‘হেফাজতে ইসলাম’।
বিতর্কিত নারীনীতি বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী আহূত হরতালের সমর্থনে গতকাল রোববার সকালে যশোর শহরের ভৈরব চত্বরে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম। শহরের বিভিন্ন প্রবেশ পয়েন্ট দিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল সকাল ১০টার পর ভৈরব চত্বরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একটি মিছিল ভৈরব চত্বরে অবস্থান নেয়ার পর পুলিশ তাদের হটিয়ে দেয়। পরে বেলা সোয়া ১১টার দিকে আরও একটি মিছিল রেলস্টেশন এলাকা দিয়ে মুজিব সড়ক ধরে ভৈরব চত্বরের দিকে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা সোয়া ১১টার দিকে মিছিলটি জিলা স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় হেফাজতে ইসলাম নেতাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর আক্রমণ করে। মিছিলকারীরাও পাল্টা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। কিছু সময় পর আকস্মিক গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। এতে মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশ ধাওয়া করে রেলস্টেশনের কাছে একটি নর্দমার মধ্যে হুসাইন আহমেদ নামে এক মিছিলকারীকে ধরে ফেলে। পুলিশ হুসাইন আহমেদকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে গুরুতর জখম করে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর হুসাইন আহমদ মারা যায়। নিহত হুসাইন আহমদ মনিরামপুরের মাদানিনগর কওমী মাদ্রাসা থেকে কুরআনে হাফেজ হওয়ার পর ওই মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে লেখাপড়া করতো। নিহত হুসাইন মাদানিনগর মাদ্রাসার মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবেও কর্মরত ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, হুসাইন আহমদ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার জীবন রক্ষার্থে অনেক কাকুতি-মিনতি করে। আশপাশের বাড়ির মহিলারাও হুসাইনকে গুলি না করার জন্য পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ জানায়। সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে পুলিশের এক সদস্য পেটে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে হুসাইনকে।
এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে লাঠি, ইট প্রভৃতির আঘাতে চার পুলিশ, এক সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। আহত তিন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলো—কনস্টেবল কামরুল ইসলাম, শামসুজ্জোহা ও হেলালউদ্দিন। এসআই মিজান প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়েছেন। কর্তব্য পালনকালে ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন স্থানীয় দৈনিক লোকসমাজের চিফ ফটোসাংবাদিক হানিফ ডাকুয়া।
ঘটনার পর বিকেলে স্থানীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির নেতারা দাবি করেন, তারা ভৈরব চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের জন্য আগেই প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও পুলিশ বিনা উস্কানিতে তাদের মিছিলে হামলা চালিয়েছে। পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়া ছাড়াও আশিকুর রহমান নামে একজন নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ আশিক মাদানিনগর মাদ্রাসার ছাত্র। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের হামলায় আহতদের একাংশের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরা হলেন— মাদানিনগর মাদ্রাসার ছাত্র মো. মাশুকুর রহমান, মো. আবদুল আলিম, মো. আবু বকর, মো. হায়দার আলী, মো. মাহমুদুল হাসান, মো. মুস্তাইন বিল্লাহ, আব্দুর রহমান, মো. বেলাল হোসেন, মো. রাশেদুল ইসলাম, আল আমিন, মো. রাশিদুল ইসলাম, যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসার ছাত্র মো. কামরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন এবং একই মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আবুল খায়ের, মাওলানা আনোয়ারুল করিম ও মাওলানা আব্দুল হক।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বিনা উস্কানিতে মিছিলে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা করা হয়। সংগঠনটির নেতারা এ ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে হেফাজতে ইসলামের নেতারা জানান, আজ আহূত হরতালে তারা মাঠে থাকবেন।
সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম নেতা মুফতি আরিফ বিল্লাহ, মীর মোহর আলী, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, আবদুল হালিম, মাওলানা আবুল খায়ের, মাওলানা আল আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গুলিতে মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়া প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন ও কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমদাদুল হক শেখ বলেন, শুধু ১২ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়েছে পুলিশ। মিছিলকারীদের কাছে রক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে হুসাইন আহমদ মারা গেছে বলে পুলিশ দাবি করেন। পুলিশ সুপার কামরুল আহসানও এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। পরে অবশ্য কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার মুস্তাফিজুর রহমান শটগানের ৭৭ রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা স্বীকার করেন। বিকেলে এ রিপোর্ট লেখার সময় ঘটনার ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি চলছিল।
অন্যদিকে মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা শোনার পর পরই যশোর সদর আসনের সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটো ও জেলা প্রশাসক মো. নূরুল আমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে হাফেজ হুসাইন আহমদ হত্যার বর্ণনা শোনেন। পরে জেলা প্রশাসক মো. নূরুল আমিন ঘটনা তদন্তে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির একমাত্র সদস্য হলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মীর জহুরুল ইসলাম।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির জেলা সভাপতি আনোয়ারুল করিম যশোরী আমার দেশকে বলেন, হরতালের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। মিছিলকারীদের হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। প্রত্যেকের হাতে ছিল পবিত্র কোরআন শরিফ। তিনি আজকের হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালনের মাধ্যমে জালিমদের অত্যাচারের জবাব দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
পুলিশের গুলিতে নিহত হুসাইন আহমদের লাশের ময়নাতদন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। বাদ আছর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশ লাশ হস্তান্তরে বিলম্ব করায় জানাজা বিলম্বে অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নিহতের জানাজা শেষে পুলিশ লাশ কর্ডন করে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে। এসময় নিহতের গ্রামের বাড়িতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
শেরপুরে জামায়াত নেতাসহ ৬ জন গ্রেফতার : শেরপুর প্রতিনিধি জানান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আহূত হরতালকে সামনে রেখে ভোরে শেরপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর জেলা মজলিশে শূরার সদস্য ও সাবেক জেলা আমির ডা. আব্দুল জলিলসহ ৬ জনকে শেরপুর সদর থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। অন্য গ্রেফতারকৃতরা হলেন শেরপুর তেরাবাজার জামিয়া সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসার সুপার মাওলানা নুরুল ইসলাম, সহকারী সুপার মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ, পূর্বশেরী মহিলা মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আজিজুল হক, তেরাবাজার মাদ্রাসার কর্মচারী খলিলুর রহমান ও সৈয়দ আহমদ। এছাড়া পুলিশ ৩২০টি পোস্টার ও প্রচারপত্র আটক করে। পরে রোববার বিকেলে শেরপুর সদর থানা পুলিশ তাদেরকে শেরপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম মিয়া মোহাম্মদ আলী আকবার আজিজীর আদালতে সোপর্দ করে। আদালত জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে তাদেরকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন।
সিরাজগঞ্জে মিছিলে পুলিশের বাধা : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাতিল এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ও ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় বাতিলের দাবিতে সিরাজগঞ্জে ওলামা-মাশায়েখদের সভায় বাধা দিয়েছে পুলিশ। তানযীমুল মাদারিস দ্বীনিয়া সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার উদ্যোগে গতকাল সকাল ১০টায় স্বাধীনতা স্কয়ারে ডাকা সভা করতে না পারায় আলেমদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরে রেলওয়ে কলোনি কওমী মসজিদে মাওলানা মাহমুদুল আলমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী, মাওলানা নজরুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুস সালাম, মাওলানা আম্বর আলী, মাওলানা আহম্মদ আলীসহ প্রমুখ

No comments:

Post a Comment