Wednesday 23 February 2011

থামছে না শেয়ারবাজারের ধস : ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় : অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি, লেনদেন স্থগিত রাখার আহ্বান


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

কোনো কিছুতেই পতন ঠেকানো যাচ্ছে না শেয়ারবাজারের। দরপতনের শিকার হয়ে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে রাস্তায় নেমে আসছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারপরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। গতকাল বিরোধী দলের ডাকা হরতাল উপেক্ষা করে লেনদেন চালু রাখা হলেও শেয়ারবাজারে দরপতন ঠেকানো যায়নি। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্য সূচকের পতন হয়েছে ৩২৪ পয়েন্টে। এ নিয়ে টানা তিন দিন বড় ধরনের দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। মাত্র তিন দিনের দরপতনে ডিএসই সাধারণ সূচকের পতন হয়েছে ১০১৫ পয়েন্টের। শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতনে গতকালও রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী। তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কড়া সমালোচনা ও তার পদত্যাগ দাবি করেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, এসইসি চেয়ারম্যান ও ডিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগও দাবি করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে লেনদেন স্থগিত রাখারও আহ্বান জানান তারা। আগের দিনও দরপতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছিলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ৫টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। আজ থেকে হাউসগুলো লেনদেন শুরু করতে পারবে। আগ্রাসী সেলের কারণে গত ২০ জানুয়ারি ৬টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রমে এক মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছিল এসইসি। এর মধ্যে এনসিসি ব্যাংকের লেনদেন কার্যক্রম চালু করার অনুমতি দেয়া হলেও বন্ধ ছিল অপর ৫টি ব্রোকারেজ হাউসের। এ হাউসগুলো হলো—আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, অ্যালায়েন্স সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা ব্যাংক, পিএফআই সিকিউরিটিজ ও আইআইডিএফসি সিকিউরিটিজ হাউস। তবে লেনদেন কার্যক্রম চালু হলেও তাদের বিরুদ্ধে চলমান আইনি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান।
অপরদিকে গতকাল হরতাল সত্ত্বেও কোরাম পূর্ণ হওয়ায় শেয়ারবাজারে লেনদেন কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। অন্যান্য সময়ে হরতালে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর লেনদেন কার্যক্রম চালু রাখার উদাহরণ তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রকিবুর রহমান ডিএসই প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে চাপ সৃষ্টি করে হরতালে লেনদেন চালু রাখতে বাধ্য করেন। সরকারের কাছের লোক হিসেবে পরিচয় দেয়া রকিবুর রহমান নিজের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে হরতালে লেনদেন চালু রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় লেনদেন চালু রাখার জন্য বিভিন্ন সদস্যের প্রতি চাপ প্রয়োগ করা হয়। হরতালের আগের দিন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে কোরাম সঙ্কট যাতে না হয় সেজন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। অন্যথায় বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুশিয়ারি দেয়া হয়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে লেনদেন চালু রাখতে হচ্ছে। গতকালও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে লেনদেন চালু হলেও শেয়ারবাজারের পতন বন্ধ করা যায়নি। ক্রমাগত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে গতকালের দরপতনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হরতালে কৃত্রিম উপায়ে হলেও শেয়ারবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হবে। সে চেষ্টাও ছিল। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। লেনদেনের শুরুতেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর হারায়। আর মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যেই ডিএসই সূচকের পতন ঘটে ২৫০ পয়েন্টের। এ পতনের পর বাজারকে কিছুটা টেনে ধরার চেষ্টা চালানো হয়। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয় করে বাজারকে টেনে ধরার নির্দেশনা দেয়া হয়। এর ফলে শেয়ারবাজারের সূচকে বড় ধরনের ঊর্ধ্বমুখী ধারা তৈরি হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কেনার সক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে বাজারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শুরু হয় দরপতন। এ দরপতনে আগের দিনের তুলনায় ডিএসই সাধারণ সূচক ২৭০ পয়েন্টের পতন হলে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে রাস্তায় নেমে আসেন। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসার ফলে হরতালে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করলেও তা পুরো বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপি আহূত হরতালে মতিঝিল এলাকায় কোনো পিকেটারের উপস্থিতি ছিল না। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসার ফলে ওই এলাকায় হরতালের পুরো আমেজ তৈরি হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানান, তারা কোনো দলের লোক নন এবং কারো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
হেদায়েত উল্লাহ সিকিউরিটিজ হাউসে লেনদেন করা সুমন উদ্দিন নামে বিক্ষোভে অংশ নেয়া একজন বিনিয়োগকারী জানান, এখানে কোনো রাজনৈতিক কিছু নেই। সবার অস্তিত্বে আঘাত এসেছে। যারা রাস্তায় নেমে এসেছেন তারা সবাই সাধারণ বিনিয়োগকারী। হাফিজুর রহমান সবুজ নামে আরেকজন বিনিয়োগকারী জানান, সব শ্রেণীর লোক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। এখানে সরকার বা বিরোধী দল বলে কোনো কিছু নেই। যদি কিছু থেকে থাকে তা তাদের একান্ত নিজস্ব। মনিরুল ইসলাম নামে আরেকজন বিনিয়োগকারী বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন। মিজানুর রহমান নামে একজন বিনিয়োগকারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, কিন্তু এখন তা ৫ লাখে নেমে এসেছে। আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমার আর কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ : পুঁজিবাজারে দরপতনে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভে আগের দিনের মতো গতকালও উত্তাল ছিল মতিঝিল এলাকা। বিনিয়োগকারীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল-সমাবেশ করে এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকের সামনেও বিক্ষাভ প্রদর্শন করেন এবং গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেন। বিনিয়োগকারীরা বেলা সোয়া ৩টার দিকে বিভিন্ন অফিসে ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। এতে আইএফআইসি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএসহ বেশ কয়েকটি অফিসের কাচ ভেঙে যায়। এসব ভাংচুরের ঘটনায় কিছু টোকাইকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। জামা খুলে বিনিয়োগকারীদের প্রতিবাদ : শেয়ারবাজারে দরপতনে গায়ের জামা খুলে অভিনব পন্থায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পুঁজি হারানোর প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে তারা জামা খুলে ফেলেন। তারা বলেন, শেয়ারবাজারে যেভাবে দরপতন হচ্ছে তাতে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। তারই প্রতিবাদস্বরূপ আমরা আজ জামা খুলে ফেলেছি। এর পরও যদি সরকারের টনক না নড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক আকার ধারণ করবে।
অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের যত ক্ষোভ : গতকাল বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপর। বিভিন্ন সময়ে অর্থমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন উল্লেখ করে তারা বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরির পেছনে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনেকাংশে দায়ী। শেয়ারবাজারকে ‘জুয়ার বাজার’ এবং অব্যাহত দরপতন হলেও এটিকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করে মূলত তিনি বিনিয়োগকারীদের পথে বসাতে চাইছেন। গত এক মাস ধরে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরও তিনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে পারে, এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং বিভিন্ন সময়ে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে উপহাস করেছেন। সরকারের ২৬টি কোম্পানির শেয়ার আনা যখন বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তখন তিনি তা করতে পারেননি। তখন যদি তিনি ভূমিকা পালন করতেন তাহলে শেয়ারবাজারে এ ধরনের বিপর্যয় হতো না। লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসতেও হতো না। শেয়ারবাজার পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে ব্যর্থ দাবি করে তারা অচিরেই তার পদত্যাগ দাবি করেন। তারা বলেন, অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করলেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, এসইসি চেয়ারম্যান ও ডিএসই প্রেসিডেন্টেরও পদত্যাগ দাবি করেন। ট্রেড বন্ধ রাখার আহ্বান : শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতনের কারণে লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেন, যেভাবে বাজারে দরপতন হচ্ছে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থায় লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, লেনদেন চালু রাখা হলে বিনিয়োগকারীরা তা বন্ধ করে দেবে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা দায়ী থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে অসন্তোষ : শেয়ারবাজারে অস্থিরতার পেছনে বিরোধীদলের ভূমিকা রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা বলেন, সরকার নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
ডিএসইর সঙ্গে তদন্ত কমিটির বৈঠক : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে আজ শেয়ারবাজার কারসাজির ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপির ডাকা হরতালের কারণে তা এক দিন পিছিয়ে দেয়া হয়

No comments:

Post a Comment