Sunday 27 March 2011

দু’বছর আগে বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী : বিনিয়োগকারীদের ‘ফটকাবাজ’ আখ্যা দেয়ায় ক্ষোভ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

দু’বছর আগে শেয়ারবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) একাউন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০০৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এসইসি কার্যালয় পরিদর্শন শেষে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ বিও একাউন্ট রয়েছে শিগগিরই সে সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী যখন বিও একাউন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলেছিলেন তখন সে সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ। কিন্তু দুই বছর পরও বিও একাউন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়নি। সেন্ট্রাল ডিপোজেটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিও একাউন্টের সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪টি। অর্থমন্ত্রীর সে ঘোষণা অনুযায়ী বিও একাউন্টধারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে এখনও আরও ৪ লাখ বিও একাউন্ট খোলা বাকি রয়েছে। অথচ এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজারের নতুন বিনিয়োগকারীদের ‘ফটকাবাজি’ করে লাভবান হতে বাজারে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন। পতনমুখী বাজারে আসা নতুন বিনিয়োগকারীদের শাস্তি পেতে হবেই বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে পুঁজিবাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞরা রীতিমতো অবাক হয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অবিবেচনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন তারা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে যারপর নাই বিস্মিত। প্রসঙ্গত, গত রোববার অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেন, শেয়ারবাজারে দরপতনের পরও নতুন এক লাখ বিনিয়োগকারী ঢুকেছে। তারা ফটকাবাজি করে লাভবান হতে চাচ্ছে। তাদের শাস্তি পেতে হবেই। বর্তমানে শেয়ারবাজারে ফটকাবাজির সঙ্গে জড়িতদের কোনো ধরনের শাস্তির আইন নেই বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান, সংসদের চলতি অধিবেশনে এ সংক্রান্ত একটি আইন উপস্থাপন করা হবে। অবশ্য অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন তার দলের সংসদ সদস্যরাও।
ফটকাবাজি করে নতুন বিনিয়োগকারীরা কিভাবে লাভবান হবেন তা তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না। বরং বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজার থেকে চিহ্নিত এবং সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন লোকজনই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো কথা না বলে এখন নতুন বিনিয়োগকারীদের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এর আগে ১৯৯৬ সালেও সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকেরা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবারও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে তারাই জড়িত। তাদের কারণেই লাখ লাখ বিনিয়োগকারী আজ নিঃস্ব হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতা এবং প্রভাবশালী মহলের কারসাজিতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হলেও সরকারের শীর্ষ মহল থেকে এজন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা হয়। এখন আবার নতুন বিনিয়োগকারীদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন। কামরুল হুদা নামের একজন বিনিয়োগকারী বলেন, আমরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসেছি। বর্তমানে বাজারে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে। অব্যাহত দরপতনের কারণে অধিকাংশ মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দর ক্রয়ানুকূলে রয়েছে এবং বিনিয়োগের জন্য এখনই উপযুক্ত সময় বলে সরকারসহ স্টক এক্সচেঞ্জের নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলে শাস্তির ভয় দেখানো হচ্ছে। এতে করে ধারণা করা হচ্ছে, সরকার চাইছে না নতুন করে কোনো বিনিয়োগকারী বাজারে আসুক। কিন্তু বিনিয়োগকারী আসতে পারবে না বা আসা উচিত হবে না—এ ধরনের কোনো কথা আমরা শুনিনি। তাহলে কেন অর্থমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন এমন প্রশ্ন রেখে কামরুল হুদা বলেন, অর্থমন্ত্রী এর আগেও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে নানা ধরনের উপহাসমূলক বক্তব্য রেখেছেন। বিনিয়োগকারীদের ‘স্টুপিড’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখন আমাদের ফটাকাবাজ বলা হচ্ছে। এ ধরনের অর্থমন্ত্রী দিয়ে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না।
এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বর্তমান পতনমুখী বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীর আগমন একটি ভালো সংবাদ। বাজারে একের পর এক দরপতনে অনেক বিনিয়োগকারী যেখানে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন সেখানে নতুন বিনিয়োগকারীর আগমন বাজারের জন্য স্বস্তিদায়ক খবর। বর্তমান অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ক্রয়ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় শেয়ারের চাহিদা কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগকারীর আগমনের ফলে বাজারে চাহিদা তৈরি হবে এবং বাজারে চলমান তারল্য সঙ্কট কাটানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করবে। তারা মনে করেন, এখন বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানানো উচিত। তবে একই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীরা যাতে পুঁজিবাজার সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারেন সে জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাজার বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজারে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারল্য সঙ্কট। এ কারণে বাজারে শেয়ারের চাহিদা কমে গেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর শেয়ার কেনার ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগকারীর বাজারে আগমনের ফলে শেয়ারের চাহিদা তৈরি হবে এবং বাজার স্থিতিশীল হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। নতুন বিনিয়োগকারীর আগমনকে স্বাগত জানানো উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ডিএসইর বেশ ক’জন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, বর্তমানে শেয়ার ক্রয়ের জন্য অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বাজারে বিনিয়োগের জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। আইসিবিকে শেয়ার কেনার জন্য ফান্ড দেয়া হচ্ছে। তাহলে কেন এতসব করা হচ্ছে? এখন যদি সাধারণ বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনে ‘ফটকাবাজি’ করে থাকে তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে সরকার কি ফটকাবাজি করছে না? আর এসব প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে যে টাকা দেয়া হচ্ছে তা জনগণের টাকা। এখন এ জনগণের টাকা দিয়ে সরকারকে ফটকাবাজি করার অধিকার কে দিয়েছে? সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যদি বিনিয়োগ না করেন তাহলে শেয়ারবাজারে কারা লেনদেন করবে—অর্থমন্ত্রীকে তা স্পষ্ট করতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর একজন সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারে নতুন বিও একাউন্ট খোলা যাবে না, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়নি। ফলে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের আগমন বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যদি একটি ব্রোকারেজ হাউস কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ব্যতীত বিও একাউন্ট খুলতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকে তাহলে তাকে এসইসির কাছে জবাবদিহি করতে হতো। এমনকি তার বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা হতো। তিনি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং অবিবেচনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেন।

No comments:

Post a Comment