Sunday 27 March 2011

ইসলামী দলগুলোর বিক্ষোভে উত্তাল রাজধানী : ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিহতের ঘোষণা











স্টাফ রিপোর্টার
কোরআনবিরোধী নারীনীতি ও ফতোয়াবিরোধী আদালতের রায় বাতিল, ধর্মহীন শিক্ষানীতি সংশোধন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজিকে অপসারণের দাবিসহ সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে অধিকাংশ ইসলামী সংগঠন। অভিন্ন দাবিতে ইসলামী দলগুলোর পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর মুক্তাঙ্গন। জুমার নামাজের পরপরই বিভিন্ন দাবিতে মুক্তাঙ্গন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ, মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি এবং চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশকিছু সংগঠন। বিক্ষোভ চলাকালে বেশ কয়েক ঘণ্টা মুক্তাঙ্গন ও পল্টন এলাকার সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পানিকামান, রায়ট কার ও প্রিজনভ্যান নিয়ে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়।
এসব সমাবেশে বক্তারা বলেন, কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন না করার ওয়াদা করেও সরকার ক্ষমতায় এসে একের পর এক ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের এদেশে কোরআন-হাদিস বিরোধী বিভিন্ন আইন করায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। তারা বলেন, সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছে। অনৈসলামিক পদক্ষেপ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলতে থাকবে। জীবনের বিনিময়ে হলেও এদেশে ইসলামবিরোধী কোনো আইন করতে দেয়া হবে না। তারা বলেন, বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার আমাদের ঈমান নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। তাই আমরাও তাকে গদি থেকে টেনে নামাবো। ঈমান ও কোরআন রক্ষার জন্য ৪ এপ্রিলের হরতাল বাস্তবায়নে কাফনের কাপড় পরে মাঠে নামার আহ্বান জানান ওলামারা। এছাড়া ১৪ মে পল্টনের মহাসমাবেশ সফলেরও আহ্বান জানান তারা।
সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ : দেশব্যাপী পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বাদ জুমা মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ। পরিষদের সভাপতি ও মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সভাপতিত্বে মিছিলপূর্ব সমাবেশে সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, জয়েন্ট সেক্রেটারি ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী ও আলমগীর মজুমদার, অ্যাডভোকেট আবদুল মোবিন, আবুল খায়ের, মমতাজ চৌধুরী, শেখ আনোয়ারুল হক, ড. মাওলানা আবদুল কাইয়ূম, মাওলানা শাহ আরিফ বিল্লাহ সিদ্দিকী, মিরসরাইর পীর মাওলানা আবদুল মোমেন নাছেরী, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, অধ্যাপক আবদুস ছবুর মাতব্বর, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা সালেহ সিদ্দিকী, মুফতি মাওলানা এনামুল হক মুসা, মাওলানা আহমাদুল্লাহ প্রমুখ।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেন, আমরা প্রাণ দেব তবু এদেশে ইসলামবিরোধী কোনো আইন করতে দেব না। আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আগামীদিনে ওলামা পরিষদের সব কর্মসূচি সফলের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। অধ্যক্ষ যাইনুল আবেদীন বলেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের এদেশে একটি গোষ্ঠী ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু ইসলাম, কোরআন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও তা প্রতিহত করা হবে।
মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, ইসলামবিরোধী নারীনীতি, শিক্ষানীতি, ফতোয়াবিরোধী রায় ও ইফা ডিজিকে বহাল রাখা বর্তমান সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দীনদার মানুষের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে শরিক না হলে সরকারকে আইয়ুব খানের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে। সময় থাকতে সরকারকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, দলমত নির্বিশেষে আলেমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। কঠোর কর্মসূচি দিয়ে ইসলামবিরোধী শক্তির মোকাবিলা করা হবে। ড. খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না। বক্তারা আগামী জুমাবার সারাদেশের বৃহত্তর জেলাগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ১৪ মে পল্টনের মহাসমাবেশ সফল করার জন্য সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে বিশাল একটি মিছিল বের হয়ে মুক্তাঙ্গন, জিরো পয়েন্ট, তোপখানা, প্রেস ক্লাব,ও হাইকোর্ট ঘুরে বায়তুল মোকাররম হয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ভাসানী ফ্রন্ট, এনডিপি, জাতীয় ফতোয়া বোর্ড, খেলাফত মজলিস, ইছলাহুল মুসলেমীন, আইম্মাহ পরিষদ, আহকামে শরিয়া হেফাজত কমিটি, মাদ্রাসা ছাত্রকল্যাণ পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক ব্যানার নিয়ে যোগ দেয়। সারাদেশে বাদ জুমা একই ধরনের মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি : বিভিন্ন দাবিতে ৪ এপ্রিল ঘোষিত হরতালকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বাদ জুমা মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি। এতে কাফনের কাপড় পরে কর্মীরা অংশ নেন। মিছিলপূর্ব সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, ৪ এপ্রিলের হরতাল দেশের সব ওলামা, পীর-মাশায়েখের হরতাল। হরতাল সফল করতে স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি, মাদ্রাসা, খানকা সবকিছু বন্ধ করে রাস্তায় নামতে হবে। এই হরতাল সফল হলে কোরআন ও ইসলাম রক্ষা হবে।
তিনি বলেন, যে কোর্ট কোরআন-হাদিস বিরোধী রায় দেবে, আমরা সেই কোর্ট মানি না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানি না। আমরা কোরআনের রাজনীতি করব। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা নিজ হাতে কোরআনবিরোধী নারী নীতিমালায় স্বাক্ষর করেছেন। এই হাত ধ্বংস কামনা করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ঈমান নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন। আমরা তাকে গদি থেকে টেনে নামাবো। তিনি বলেন, এবারের সংগ্রাম কোরআন প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ এবং বাস্তবায়নের সংগ্রাম। হরতালের আগে প্রতিদিন কর্মসূচি চালানোর ঘোষণা দেন তিনি। সমাবেশে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাজই হলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, বর্তমানে দেশে কোনো সংবিধান নেই। অসাংবিধানিকভাবে সরকার দেশ চালাচ্ছে। মুফতি শহীদুল ইসলাম বলেন, আমরা বদরের মতো ৩১৩ জন কাফনের কাপড় পরে এই সমাবেশে এসেছি। এরপরও যদি সরকার ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে না ফিরে আসে, তাহলে এমন সিদ্ধান্ত নেব যাতে তাদের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে যায়।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মাওলানা জোনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা শফিক উদ্দীন, মাওলানা নোমান মাজহারী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিশাল একটি মিছিল পল্টন মোড়, নয়া পল্টন, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা হয়ে বায়তুল মোকাররমের সামনে এসে শেষ হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের কর্মসূচি পালিত হয় বলে জানা গেছে।
ইসলামী আন্দোলন : সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল বিকালে মুক্তাঙ্গনে বিশাল সমাবেশ ও মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহাগরী। মিছিলপূর্ব সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যক্ষ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ইন্তেকালে শোক প্রকাশ এবং আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তিতে শুকরিয়া প্রকাশ করে বলেন, কলমযোদ্ধা মাহমুদুর রহমানকে এদেশের জাগ্রত জনতা যেভাবে সংগ্রাম করে মুক্ত করেছে, আমরাও সেভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের নেতাদের মুক্ত করব। যারা কোরআনের বিরুদ্ধে আইন করতে চায়, তাদের কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তিনি বলেন, সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেভাবে জনতা ফুঁসে উঠছে তাতে তাদের আখের রক্ষা হবে না। আমরা ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। মুক্তাঙ্গন হবে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। রোববারের সমাবেশ থেকে মুক্তাঙ্গনকে ঢাকার তাহরির স্কয়ার ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ বেলায়েত হোসেন, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, প্রশিক্ষণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা মকবুল হোসাইন, অ্যাডভোকেট একেএম এরফান খান, নগর সহ-সভাপতি মাওলানা এবিএম জাকারিয়া, সেক্রেটারি মো. আবু সাঈদ সিদ্দিকী, মাওলানা আতাউর রহমান আরেফী, মুহাম্মদ মুনিরুল ইসলাম প্রমুখ। সমাবেশে রোববার প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদানপূর্ব মুক্তাঙ্গনে জমায়েত ও রায় ঘোষণার দিন হাইকোর্টের সামনে গণঅবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সমাবেশ শেষে একটি বিশাল গণমিছিল পুরানা পল্টন মোড়, বিজয়নগর নাইটিংগেল মোড় হয়ে পুনরায় পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও দৈনিক বাংলা মোড় ঘুরে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে শেষ হয়।
বাংলাদেশ কওমি কাউন্সিল : এদিকে বিকালে ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘অস্তিত্বের সঙ্কটে কওমি মাদ্রাসা : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেফাক সিনিয়র সহ-সভাপতি শায়খুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী বলেন, ঐতিহ্যবাহী কওমি শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি নানা আগ্রাসনের কালো থাবা পড়ছে, যার অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীন সরকার ধর্মহীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে দেশকে ধর্মহীন করতে চায়। অতএব কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যা থামানোর ক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই। সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের চেয়ারম্যান প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুস সামাদ সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেন, বেফাক প্রস্তাবিত ১২ দফা দাবি মেনে নিতে হবে। অপরদিকে সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী ছাত্র মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া ইত্যাদি সংগঠন

No comments:

Post a Comment