Wednesday 23 February 2011

আড়িয়ল বিল রক্ষায় গণবিস্ফোরণ সংঘর্ষে এসআই নিহত, ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিক পুলিশসহ আহত শতাধিক, ফাঁড়িতে আগুন


মাহবুবুর রহমান ও শফিকুল ইসলাম, শ্রীনগর থেকে

মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার সরকারি উদ্যোগের প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হাজার হাজার লোকের সঙ্গে গতকাল দিনভর পুলিশের সংঘর্ষে শ্রীনগরের হাঁসাড়া পয়েন্ট রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও বিলবাসীর মধ্যে দফায় দফায় ব্যাপক সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ, গাড়ি ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
হাজার হাজার নারী-পুরুষের বিশাল সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি জোর করে পণ্ড করতে চাইলে আড়িয়ল বিলবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশ গুলি, টিয়ারশেল, জলকামান দিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হাজার হাজার নারী-পুরুষ গাছের ডাল, গুলতি, লাঠি, দা ও ইটপাটকেল নিয়ে পুলিশকে মোকাবিলা করে। দু’পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের একপর্যায়ে জনতার ঘেরাওয়ের মধ্যে পুলিশের একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে আক্রমণ চালালে ৬/৭ জন পুলিশ আহত হয়। এদের মধ্যে একজন এসআই মতিউর রহমান হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। এছাড়া সংঘর্ষে ম্যাজিস্ট্রেট, সাংবাদিকসহ শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। পুলিশ বিলবাসীকে ছত্রভঙ্গ করতে দফায় দফায় গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ে। সংঘর্ষের জের ধরে এলাকায় গণবিস্ফোরণ সৃষ্টি হলে পুলিশ একপর্যায়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে পিছু হটে। ক্ষুব্ধ জনতা একপর্যায়ে হাঁসাড়া পুলিশ ফাঁড়িটিও জ্বালিয়ে দেয়। টানা ৯ ঘণ্টা সংঘর্ষের পর বিকাল ৪টার দিকে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও এলাকায় উত্তেজনা ও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার জনতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে বিল রক্ষা কমিটি আহূত ও অনুমোদিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসক আজিজুল আলম ও পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম ছুটে যান। ৮ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে বিল রক্ষা কমিটির কর্মসূচির ফলে বাড়তি সতর্কতার জন্য প্রশাসন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া থেকে লৌহজংয়ের মাওয়া পর্যন্ত সড়কে সকাল ৭টা থেকে সবধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে দুদিকে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। পরে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে পুলিশ ব্যাপক বলপ্রয়োগ করে আন্দোলনরত বিলবাসীকে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির ব্যানারে প্রায় ৪০ হাজার নারী-পুরুষের জমায়েত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের হাঁসাড়া পয়েন্টে। বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে নারী-পুরুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এছাড়া তাদের হাতে লাঠিসোটা দেখা গেছে।
এদিকে আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির নেতারা দাবি করেছেন, পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হামলার ঘটনায় ২০ মহিলা ও শিশুসহ শতাধিক বিক্ষোভকারী মারাত্মক আহত হয়েছেন। তাদের অনেকের শরীরেই গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাদের হাসপাতালে পাঠাতে অমানবিকভাবে বাধা দিয়েছে।
আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান বাদল বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর জোর দিয়েছি। সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দিলে বিপর্যয় দেখা দেবে। আমরা আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি আড়িয়ল বিল রক্ষা করব। এদিকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. শফিকুল ইসলাম।
গুরুতর আহত অবস্থায় এসআই মতিউর রহমানকে মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তির পর কর্তব্যরত চিকিত্সকরা বেলা আড়াইটার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দাঙ্গা বিভাগে কর্মরত ছিলেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। সংঘর্ষে আহত আরও ৭ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৪ জনকে মিটফোর্ড এবং ৩ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা গুরুতর। মিটফোর্ডে চিকিত্সাধীন পুলিশ সদস্যরা হচ্ছেন হালিম (২৮), আবদুল হক (৩৫), রাজিউল ইসলাম (৩৫) এবং শাহাবউদ্দিন (৩৫)। ঢামেকে চিকিত্সাধীন রয়েছেন আনোয়ার হোসেন (৩২), মুনির হোসেন (৩৯) এবং কামাল হোসেন (৩০)। এ ঘটনায় কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট শাফিউল ইসলাম, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিউদ্দিন বিটু, দৈনিক ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক সাজেদ হোসেনসহ আহত হয়েছেন শতাধিক লোক। আহত ম্যাজিস্ট্রেটকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার ভোর থেকেই আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির ডাকে প্রায় ৪০ হাজার লোক মুন্সীগঞ্জ সংলগ্ন ঢাকা-মাওয়া সড়কের ষোলঘর এলাকায় প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়কে গাছ ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করে। এতে ঢাকা-মাওয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ঢাকার জুরাইন থেকে মাওয়াগামী পোস্তগোলা সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা ব্রিজে কোনো যানবাহন উঠতে দেয়নি পুলিশ। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল বাশার বলেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য ব্রিজের আশপাশে ৩ প্লাটুন পুলিশ পাহারা বসানো হয় এবং সবধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার ওসি শাখাওয়াত হোসেন জানান, গতকাল সকাল থেকেই বাড়ৈখালী, নবাবগঞ্জ ও দোহার এলাকার বহু লোক বিমানবন্দরের বিপক্ষে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কাছে জড়ো হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লোকজন ছনবাড়ি থেকে কুচিয়ামোড় পর্যন্ত মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
আহত পুলিশ সদস্যরা জনতার সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এলাকা ঘুরে এসে আমাদের মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মো. মাহবুবুর রহমান ও শ্রীনগর প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম জানান, দুপুর ১২টার দিকে ছনবাড়ি থেকে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল শ্রীনগর বাজারের দিকে এগুতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে পুলিশ-বিলবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে বিলবাসীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও জলকামানের সাহায্যে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে বিতাড়িত জনতা ষোলঘরে এসে জড়ো হয়। পুলিশের হামলার খবর শুনে উত্তেজিত জনতা হাঁসাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আবার হাঁসাড়ার কালিকিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এদিকে মহাসড়কের হাঁসাড়া পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ২০০ গজের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ৫-৭টি প্রাইভেট গাড়ি ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা স্থানীয় এমপি সুকুমার রঞ্জন ঘোষের ছবি সংবলিত ৭/৮টি তোরণ পুড়িয়ে ফেলে।
উল্লেখ্য, আড়িয়ল বিল ঢাকা জেলা, মুন্সীগঞ্জ জেলা ও পদ্মা নদীর মাঝখানে একটি ছিটমহলসম জলাভূমি অঞ্চল। এককালে এলাকাটি বিক্রমপুর নামেই পরিচিত ছিল। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। এ বিলের দৈর্ঘ্য ২৬ মাইল এবং প্রস্থ ১০ মাইল। বিলটিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনবসতি, শস্যক্ষেত, মাছেভরা জলাশয় এবং রয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য পাখির বিচরণক্ষেত্র। তবে সরকার কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ১০ হাজার একর এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নগরীর জন্য ১৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে আড়িয়ল বিলবাসী প্রতিদিন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এই বিলে বিমানবন্দর হলে প্রায় ১০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রস্তাবিত ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে শ্রীনগর উপজেলার ১৪ মৌজা, নবাবগঞ্জ উপজেলার ১৮ মৌজা এবং দোহার উপজেলার ৭টি মৌজা থেকে। বিল রক্ষা কমিটি দাবি করেছে, এ বিলে বছরে ধান ৪০ হাজার টন, মাছ ৭শ’ টন ও সবজি উত্পাদন হয় ১০ হাজার টন।

No comments:

Post a Comment