Friday 25 May 2012

মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে তোলপাড় বাংলাদেশে সরকারবিরোধীদের জন্য ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ নয়া দিগন্ত ডেস্ক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন নিয়ে দেশে তোলপাড় চলছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, এতে তাদের অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্য দিকে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, এ রিপোর্টে তারা উদ্বিগ্ন নন। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এই প্রতিবেদন দেশে ঘটমান বাস্তবতার প্রতিফলন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে রাজনীতিকরণ করে বিরোধী দলের সদস্যদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারসংক্রান্ত সমস্যাবলির সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন; সামাজিক সহিংসতা, নারীদের প্রতি বৈষম্য; সামাজিক সহিংসতা থেকে আদিবাসী লোকদের রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতা। অন্যান্য মানবাধিকার সমস্যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুম, হেফাজতে মৃত্যু, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটকসহ ক্ষমতার অপব্যবহার। কারাগারের অবস্থা অনেক সময় জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ, বিচার-পূর্ব দীর্ঘ দিন আটক থাকাও বড় সমস্যা। বিপর্যস্ত বিচারব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতিকরণ করে এর সমস্যা আরো বাড়ানো হয়েছে এবং বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। সরকার যে কথা বলার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করেছে, তার অনেক ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়া স্ব-সেন্সরশিপও বহাল রয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী সাংবাদিকদের হয়রানি অব্যাহত রেখেছে। সরকার সমাবেশ করার স্বাধীনতা খর্ব করেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা এখনো সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সরকারিপর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি এখনো একটি মারাত্মক সমস্যা। এতে বলা হয়, দায়মুক্তি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই, বিশেষ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দায়মুক্তির আওতায় কাজ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার ব্যাপকভিত্তিক কোনো তদন্ত করে না। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিজিবি) ও র‌্যাব প্রায়ই কর্তৃত্ববহির্ভূত ভয়ঙ্কর শক্তি প্রয়োগ করে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারমূলক অনেক কাজের অভিযোগ রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কতজন নিহত হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করেনি। এসব ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার ব্যাপকভিত্তিক কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। মিডিয়া রিপোর্ট, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সরকারি সূত্রের তথ্যানুযায়ী ২০১১ সালে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৬৮। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, গত বছর নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেছে ২১৬ জন। সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশী নিহত হওয়ার ঘটনা এখনো সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, গত বছর ৩১ জন নিহত হয়েছে; আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৫৮। উদাহরণ হিসেবে ১৫ বছর বয়সী ফালানী খাতুনের কথা বলা যেতে পারে। সীমান্ত অতিক্রমের সময়ে ভারতীয় বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। ভারতীয় বাহিনী তার লাশ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার আগে ফালানী ১৫ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় পড়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে গুম, অপহরণ বেড়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ঠিক কতজন এ অবস্থার শিকার, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অপহরণের কয়েকটি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব মতে, গত বছর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অপহরণের ৩০টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯। অধিকারের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে অন্তত ৪৬ জনের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন চালিয়েছে। সরকার বলতে গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এর মধ্যে মানবাধিকার অপরাধের অভিযোগে আটক বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। তার পরিবার এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে পুলিশ তা অস্বীকার করে। এ ছাড়া বিরোধী দল বিএনপির ডাকা হরতালে সংসদ সদস্য চিফ হুইফ জয়নুল আবদিন ফারুক পুলিশের হাতে নির্যাতিত হন। সংবিধানে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটকের বিরুদ্ধে বিধান থাকলেও কোনো পরোয়ানা ছাড়াই কর্তৃপক্ষ আইনবলে অপরাধমূলক তৎপরতায় জড়িত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারে। আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বিরোধী দলের হরতাল কালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সমালোচনা করেছেন। র‌্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদের দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র‌্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে। প্রত্যদর্শীরা বলছেন এবং রফিকুলের জামাতা পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, র‌্যাব অফিসাররা আটক করেছেন রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কাভার্ডভ্যানে তুলে নিয়েছে। এ সময় র‌্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্তু র‌্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়। এ দিকে ২০১০ সালের জুনে র‌্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন। প্রতিবেদনে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগের বেলায় পুলিশ সাধারণত অকার্যকর ও অনীহা থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দায়মুক্তি সুবিধা ব্যাপক। নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও সেটি প্রয়োগ করা হয় না। এতে ২০১০ সালের অক্টোবরে বিএনপির মিছিলে হামলা চালিয়ে নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে খুন করা হয়। খুনের দায়ে আটক ছাত্রলীগের ২৭ জনের সবাই জামিন পেয়ে যান। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বাবুকে পিটিয়ে হত্যা করছেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মামলাটি চলবে; কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি পরে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের কর্মীদের বলেন, এ ঘটনা নিয়ে ‘চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই’। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, দিনে দুই সহস্রাধিক লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই দু-এক দিন পরে ছাড়া পাচ্ছেন, ঘুষের বিনিময়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতার অভিযান চালায়। বিচার বিভাগ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনে আছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু সংবিধানের দীর্ঘ দিনের একটি অস্থায়ী বিধানের কারণে নির্বাহীরা নিম্ন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা বিচার বিভাগের নিয়োগ দেন। আইনের মাধ্যমে ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের নিয়োগে রয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় সরকার বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাদের জামিন ও আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত। ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের শপথ গ্রহণ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ওই সব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা জানান, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধিবিধান থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ করে না সরকার। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সাথে জড়িত। এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির মামলা ছিল, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই নির্বাহী আদেশবলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে; অথচ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা খুব কম মামলাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। বছরজুড়ে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আগের সরকারের আমলে দায়ের করা মামলাগুলোতে ক্ষমা মঞ্জুর করেন, যা দৃশ্যত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ক্ষমা পাওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তিই আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত। এসব ক্ষমার অনেকগুলো সুশীলসমাজের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার বিভাগে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। এতে বলা হয়, আগস্টে ডেইলি স্টারের এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বিস্তর টাকা গ্রহণ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী খারিজ করে দেয়া রায়ের পর খায়রুল হক ও হাইকোর্টের আরো কয়েকজন ওই তহবিল থেকে টাকা পেয়েছিলেন। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই অর্থ হস্তান্তর নিশ্চিত করেছে। আর খায়রুল হক জানান, ওই টাকা ব্যয় হয়েছে তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষের আইনজীবীর উদ্ধৃতি দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ভীতি প্রদর্শন করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সমালোচনাকারী সংবাদপত্রগুলো সরকারি চাপের মুখে পড়ে। ফ্রিডম হাউজের ২০১০ সালের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মিডিয়া আংশিকভাবে মুক্ত। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দু’টি টেলিভিশন চ্যানেল (চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি) বন্ধ করে দেয়। উভয় চ্যানেল এখনো বন্ধ। সরকার রাজনৈতিক সমর্থকদের নতুন টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধীদের দেয়নি। এত বলা হয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এখনো মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বহাল রয়েছে। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কিত লোকদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি বেড়েছে। অধিকার ও মিডিয়া ওয়াচডক গ্রুপগুলোর মতে, গত বছর অন্তত একজন সাংবাদিক নিহত ও ১৩৯ জন আহত হয়েছেন, একজন গ্রেফতার হয়েছেন, ৪৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন, ৫৩ জন হুমকি পেয়েছেন এবং ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ছাত্র গ্রুপগুলোও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সরকার সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে না। সরকারের সমালোচক ও বিরোধীদের সাথে সম্পর্কিত সাংবাদিকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের নির্যাতন নেমে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০ মে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন একটি বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গিদের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রমাণ রয়েছে। সরকার চাইলে ওই সম্পাদককে গ্রেফতার করা যেতে পারে। সিদ্দিক ওই সম্পাদকের নাম প্রকাশ করেননি, কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। ৩১ জুলাই কর্তৃপক্ষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল শীর্ষনিউজের সম্পাদক একরামুল হককে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার করে। এ অভিযোগ বানোয়াট বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একরামুলের সংবাদ পরিবেশনের প্রতিশোধ হিসেবে এটি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সরকার শীর্ষনিউজের সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেয়নি। ফলে তাদের পক্ষে সরকারি খবর কভার করা সম্ভব হয়নি। পরিণতিতে সংবাদ সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। একরামুল হক জামিনে ছাড়া পেলেও তার মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। ১২ সেপ্টেম্বর র‌্যাব সদস্যরা বাংলাভিশনের ব্রডকাস্ট ইঞ্জিনিয়ারের ওপর হামলা চালায়। ক্ষমতাসীন সরকার দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। দেশে শতাধিক দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং একমাত্র সরকারি টিভি চ্যানেল বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) আছে। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিটিভি দেখে এবং সাধারণ জনগণ ৮০ শতাংশ তথ্য এ চ্যানেল থেকেই পায়। বিটিভিতে সরাসরি সংসদ ও সরকারি অনুষ্ঠান প্রচার করলেও বিরোধী দলের মতামত খুব কম প্রচার করা হয়। এমনকি বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার প্রায়ই বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকে সভা আয়োজন ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে বাধা দিয়ে থাকে। ২০১১ সালে সরকার বিরোধী গ্রুপগুলো সভা আয়োজন থেকে বিরত রাখতে বিশেষ আইন অন্তত ১৩৩ বার প্রয়োগ করেছে। অনেক সময় পুলিশ বা ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশ বানচাল করে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তারা ২০১১ সালে মিছিল বা সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের। সন্দেহভাজনদের পাসপোর্ট জব্দ করা না হলেও বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তারা বিরোধী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিবিদদের দেশ ত্যাগে বাধা দিয়ে থাকেন। গত বছর ৩০ জুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানে একটি সংশোধনী আনে। ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের অধীনেই ২০১৩ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই সংশোধনীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও নির্বাচন পর্যবেক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছরজুড়ে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থান চলেছে। আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপে নন বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশনে যাচ্ছে না। দুর্নীতি মোকাবেলার জন্য গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সরকার ২৩ ফেব্রুয়ারি একজন সাবেক আমলা ও একজন সাবেক বিচারপতিকে নিয়োগ করে। উভয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার দুদকের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। সরকারি একটি কমিশন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ দুদকের কার্যক্রমে সরকারের হস্তক্ষেপের উল্লেখ করে বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি ‘দন্তহীন বাঘে’ পরিণত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার দলের লোকদের মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করছে না http://www.dailynayadiganta.com/details/48706

No comments:

Post a Comment