Wednesday 23 November 2011

শেয়ারবাজারে দরপতন অব্যাহত : তিনদিনে ডিএসই’র সূচক পড়েছে ৫৬০ পয়েন্ট : বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

দরপতনের কবল থেকে বের হতে পারছে না শেয়ারবাজার। গতকালও দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের বড় ধরনের পতন হয়েছে। দিনশেষে ডিএসই সাধারণ সূচকের পতন হয়েছে ২২৮ পয়েন্ট। এ নিয়ে ঈদ-পরবর্তী তিন কার্যদিবসে ডিএসই সূচকের পতন হয়েছে ৫৬০ পয়েন্টের মতো। ঈদ-পরবর্তী প্রথম দুই দিন সূচকের পতন হয়েছিল প্রায় ১৬৬ পয়েন্ট করে। গতকাল পতন ২০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে গেছে। অব্যাহত দরপতনে শেয়ারবাজারের সূচক এখন মাত্র ৪ হাজার ৬৪৯ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে এ সূচক সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছিল। মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে সূচকের এ মহাপতনে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর হাহাকারে প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে মতিঝিল এলাকা।
গতকালও পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এই কর্মসূচি শুধু ডিএসই ভবন চত্বরে সীমাবদ্ধ ছিল না, বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে। এ সময় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে দায়ী করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে নানা সেম্লাগান দেয়।
গতকাল লেনদেন শুরুর প্রথম ১৫ মিনিট সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকলেও এরপর শুরু হয় টানা পতন। পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় ২২৮ পয়েন্ট কমে শেষ হয় দিনের লেনদেন। দরপতনের প্রতিবাদে বেলা ১২টা থেকে বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেন। বেলা ১টার দিকে মিছিল নিয়ে এসইসি কার্যালয়ে যেতে চাইলে পুলিশ শাপলা চত্বরের সামনে বাধা দেয়। বিনিয়োগকারীরা তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে অবস্থান নেয় এবং রাস্তায় বসে পড়ে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের চলমান মন্দার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে নানা সেম্লাগান দেন এবং তার পদত্যাগ দাবি করেন। এসময় হ্যান্ড মাইকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টের কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয় ঘেরাও প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম শাহদাত উল্লাহ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অসময়োচিত পদক্ষেপ এবং অতিমাত্রার তদারকির কারণে বাজারে পতন শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ সঙ্কটের কারণে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আমরা গভর্নরের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে আজ পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া আবদুল রাজ্জাক নামের একজন বিনিয়োগকারী জানান, তিনি হাবিবুর রহমান সিকিউরিটিজে লেনদেন করেন। ২০১০ সালের নভেম্বরে তার বিনিয়োগ করা মূলধন ছিল ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের নভেম্বরে এসে তার মূলধন ৭০ লাখের নিচে নেমে এসেছে। এতে তিনি ৪০ শতাংশেরও বেশি বিনিয়োগ হারিয়েছেন। রাজ্জাক জমিজমা বিক্রি এবং অন্যান্য ব্যবসা বন্ধ করে জমানো সব টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন এবং এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই তার মূল আয়। পুঁজি হারিয়ে এখন আহাজারি, বিক্ষোভ আর বার বার আশায় বুক বেঁধে পতনের জালে পা দেয়া ছাড়া তার কিছুই করার নেই।
পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আরেক বিনিয়োগকারী হুমায়ুন কবির জানান, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে ফিরে জমানো সব টাকা নিয়ে ৮ হাজার সূচকে সিনহা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে বাজারে বিনিয়োগ করেন। নিজের মূলধন ছিল ৫০ লাখ এবং ঋণসহ প্রায় ১ কোটি টাকারও বেশি তার বিনিয়োগ দাঁড়ায়। কিন্তু বিপর্যয়ের পর সূচক গতকাল সাড়ে চার হাজার পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় তিনি মূল পুঁজি হারিয়ে এখন ব্রোকারেজ হাউসের কাছে ৩০ লাখ টাকা ঋণে রয়েছেন। শেয়ারাবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব এ আহমেদ নামের একজন বিনিয়োগকারী বরিশাল থেকে গতকাল রাতে আমার দেশ কার্যালয়ে ফোন করে জানান, তিনি বিভিন্নভাবে ধার-দেনা করে শেয়ারবাজারে ৫৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বিনিয়োগের বিপরীতে তিনি মার্জিন লোনও নিয়েছিলেন। এখন তার পুঁজির পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। এখন ব্রোকারেজ হাউস উল্টো তার কাছে ২ লাখ টাকা পাওনা হয়েছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা নিঃশেষ হয়ে গেছি, আমাদের বাঁচান। শেয়ারবাজারে দরপতনে এভাবে প্রতিদিনই বাড়ছে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা। আর তাদের কান্নার ধ্বনি প্রতিদিনই বাড়ছে।
গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ২৪৮টি কোম্পানির ৪ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ২৬৮টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেনের পরিমাণ ২৫২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬২ টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা কম। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক আগের দিনের চেয়ে ২২৮ দশমিক ২০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৬৪৯ দশমিক ৩৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ডিএসই-২০ মূল্যসূচক আগের দিনের চেয়ে ১৪২ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৫৭৯ দশমিক ৯৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনকৃত ২৪৮টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৮টির কমেছে ২৩৯টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১টি কোম্পানির দর।
আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে প্রধান ১০টি কোম্পানি হলো— গ্রামীণফোন, বেক্সিমকো লিমিটেড, ফু-ওয়াং সিরামিকস্, ন্যাশনাল ব্যাংক, তিতাস গ্যাস, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউসিবিএল, এমআই সিমেন্ট, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি. ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল।

No comments:

Post a Comment