বাছির জামাল ও জাকির হোসেন
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকুক—তা চায়। এ ব্যাপারে তাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আলোচনা সভা, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ ও আমার দেশ-এর সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় দলগুলো এই মত প্রকাশ করে। এসব দলের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে এমন ৩০টিরই এ মত। দলগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ১৩ শরিক ও সমমনা দল, তেমনি রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ১৩ শরিক দল। এই ৩০টি সক্রিয় দল হচ্ছে মহাজোটের শরিক জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, ১১ দলের বিভিন্ন দল, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাপ ভাসানী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রমুখ। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, দেশের রাজনৈতিক দলুগুলোর পরস্পরের মধ্যে এখনও বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচন কমিশনও শক্তিশালী নয়। এ অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঝগড়া, ফ্যাসাদ না কমা পর্যন্ত এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি মীমাংসিত বিষয়। এর অধীনে ৩টি নির্বাচন হয়েছে। জাতি এ ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ নিজের স্বার্থে একে সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিতে চায়। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের নেত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখলে এর অন্যান্য বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। আমাদের নেত্রীর এই প্রস্তাবের পর ‘বল’ এখন তাদের (সরকার) কোর্টে। এ ব্যাপারে তাদেরই পদক্ষেপ নেয়ার পালা। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আমরাই প্রথম এ ব্যবস্থার দাবি করেছিলাম। এরপর অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর এর বাস্তবায়ন হয়। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখলে একে আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, সংশোধন-বিয়োজন ও সুন্দর করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এ ব্যবস্থা যদি বাতিল করে দেয়, তাহলে তো আর আলোচনার কোনো সুযোগ থাকে না। ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের বর্তমান অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আমরা মনে করি, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যেভাবে রয়েছে, এর কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। এই সরকারের বর্তমান কাঠামো ঠিক রাখলে, প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ বলুন, আর নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথাই বলুন— এসব নিয়ে আমরা আলোচনায় বসতে পারি। কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়ের অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া মানা যায় না। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন,তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না কমা পর্যন্ত এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হোক এটা চায় না। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য মস্তবড় কলঙ্ক। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাঁয়তারা অযৌক্তিক। কোর্ট সংবিধান বাতিল কিংবা বহাল করতে পারেন না বা করেনও না। তারা সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। সংবিধান সম্পর্কে কোনো ষড়যন্ত্র হলে তার বিচার করেন। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সত্যিই অপব্যাখ্যা হচ্ছে। কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বা বহাল কোনোটাই করেননি। সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে শুধু মনে করিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আগামী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা উচিত। এ বিষয়ে সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। মহাজোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর এখন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান দরকার। এটা একতরফাভাবে কারও করা উচিত নয়। সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এটা ঠিক করা উচিত। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোর মধ্যে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এর সংশোধন এবং সংযোজন প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমরা কোনো প্রস্তাব দিইনি। এ ব্যাপারে আলোচনার পথ সম্পূর্ণ খোলা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী আরও দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও নির্বাচনে কালো টাকার খেলা বন্ধ করা উচিত। এটাই হলো আসল কাজ। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। যদিও এ সরকারে যারা থাকেন তারা ফেরেশতা নন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মতো কোনো পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে এগুলো সংশোধন করে আগামী কয়েক মেয়াদের জন্য এ ব্যবস্থা বহাল রাখা উচিত। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিলেই কেবল এই পদ্ধতিকে আরও কীভাবে ভালো ও টেকসই করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। তাছাড়া নয়। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা একটি মীমাংসিত বিষয়। জাতি এ ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। এর অধীনে ৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক-এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাপকাঠি হতে পারে না। এই একটি খারাপ দৃষ্টান্তের জন্য গোটা ব্যবস্থাই খারাপ হতে পারে না। খেলাফত মজলিস আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে কেবল নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমান সংবিধানে যেভাবে এই সরকারের কাঠামো রয়েছে, সেই কাঠামো হুবহু বহাল রেখে নির্বাচন করতে হবে। এর অন্যথা আমরা মানব না।
No comments:
Post a Comment